মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর সরকারি উদ্যোগের বিপক্ষে সবাই
2015.05.26
দেশের ৬৮টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন সমন্বয়ে গঠিত মোর্চা ‘শর্তসাপেক্ষে’ মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর করার সরকারি প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানিয়েছে। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি নামের ওই মোর্চা অন্যথায় কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মেয়েদের বিয়ের বয়স নির্ধারণের বিষয়টি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন। এরপর উল্টো বিয়ের বয়স কমাতে আইন সংশোধনের তোড়জোড় চলছে।
“১৮ বছরের কম হলে তাকে শিশু বলা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচে কোনো নারীর সম্মতিতে বা অসম্মতিতে যৌন সঙ্গম করলে তা ধর্ষণের অপরাধ। এখন যদি মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ করে আইন করা হয়, তবে তা হবে আইন করে শিশু ধর্ষণ,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির।
জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ ও বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে বিয়ের বয়স কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত আরও বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে।
সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির নেতৃত্বে দেশের প্রায় সবগুলো নারী ও সামাজিক সংগঠন ২৫ মে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ করা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নারীর বিয়ের বয়স ১৮ বছর থেকেও বরং বাড়ানো উচিত। ১৮ বছরের আগে কোনো মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে বাল্যবিবাহ প্রবর্তন করা।”
“আইন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই সরকার বাল্যবিয়ে রোধে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা করেছে। সেখানে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর ধরা হয়েছে। সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি এর নিন্দা জানায়,” লিখিত বক্তব্যে এ কথা বলা হয়।
“এই প্রস্তাবকে নারীর অগ্রগতি জলাঞ্জলি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম। তিনি বলেন, এটা বন্ধে শিগগিরই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
সরেজমিন চিত্র:
এখন ১৮ বছর বয়স নির্দিষ্ট করা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। টাঙ্গাইলের ফলদা ইউনিয়নের বাসিন্দা মরিয়ম বেগম স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলের নিবন্ধন খাতা অনুযায়ী তাঁর জন্ম ২০০২ সালের জুলাই মাসে। অর্থাৎ এখন তার বয়স ১৩ বছরও হয়নি।
অথচ চলতি বছরের মার্চ মাসে মরিয়মের বিয়ে হয়েছে। নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত বিয়ের কাগজে তার বয়স লেখা হয়েছে ১৮ বছর।
ফলদা ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে মরিয়মের সঙ্গে আলাপকালে সে জানায় তার বয়স ১৬ বছর। বিয়ের বয়স ১৮ বছর মনে করিয়ে দিতেই মরিয়মের চটপট উত্তর ‘সরকার এখন ১৬ বছর করেছে।’ যখন তাকে জানানো হলো, এই আইন হয়নি তখন চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল সে।
মরিয়মের বিয়ের খুঁটিনাটি জানা গেলো ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইদুল ইসলাম তালুকদারের কাছ থেকে। তিনি বললেন, ফেব্রুয়ারিতে এই মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি জানতে পেরে স্থানীয় প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ে বন্ধ করেছিলেন। মরিয়মের বিয়ে হয়ে গেছে, এটা পরে আর তিনি শোনেননি।
মরিয়ম ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো, বিয়ে বন্ধ হওয়ার পর মরিয়মকে নিয়ে পরিবারের সদস্যরা টাঙ্গাইল শহরে যান। সেখানে ছেলে আলামিন ও তার স্বজনেরাও আসেন। নোটারির মাধ্যমে এই বিয়ে হয়।
ময়মনসিংহ জেলার চর ঈশ্বরদিয়া ইউনিয়নে ১২ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিতে বাবা জব্বার আলী তার বড় ছেলের জন্ম সনদপত্রে ছেলের নামের স্থানে মেয়ের নাম বসিয়ে ফটোকপি করে কাজি অফিসে জমা দিয়েছেন। অবশ্য পরে ধরাও পড়েছেন। তবে তার আগেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে যায়।
কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিতে নানা ধরনের ছলচাতুরীর আশ্রয় দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় বাল্য বিয়ে রোধে প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কঠোর হলেও মূলত চারটি কারণে এই ধরনের বিয়ের সংখ্যা ব্যাপক ভাবে কমিয়ে আনা যাচ্ছে না। এগুলো হলো নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে বিয়ে, ভুয়া জন্মসনদ ও এলাকায় বিয়ে বন্ধের পর অন্য এলাকায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়া। অবশ্য এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ে নিবন্ধন হচ্ছে না।
এ ছাড়া আরও এক উপায়ে বাল্য বিয়ে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বিয়ের কাজি বিয়ের বিষয়টি নিবন্ধন খাতায় তাৎক্ষণিক ভাবে নিবন্ধন করেন না। বিয়ের পর কোনো ধরনের সমস্যা বা বাধা না আসলে ছয় মাস বা এক বছর পর নিবন্ধন খাতায় বিয়ে নিবন্ধন দেখান।
কম বয়সে মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন কেন, এই প্রশ্নের জবাবে ময়মনসিংহের কুষ্টিয়া ইউনিয়নের ধনু মিয়া “এলাকার পোলাপান সমস্যা করে। এই জন্য বিয়ে দিয়েছি”।
আর টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের হনুফা বেগম এই কারণের সঙ্গে যোগ করলেন, তার পরিবারের অভাবের কথা। বললেন, “এক মেয়ের বিয়ে হওয়ায় খাওনের লোক একজন কমল।”
এই দুটি জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, গত চার মাসে এই দুটি জেলায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ৭৩টি বাল্য বিয়ে রোধ করা গেছে। এ ছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ও বাসিন্দারা অনেক বিয়ে আটকে দিয়েছেন।
বাল্যবিয়ে বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম শুরু করেছে খুলনা জেলা তথ্য অফিস। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি জেলার বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে 'বালিকাবধূ নয়' শীর্ষক চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর।
“যথাযথভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করার মাধ্যমেই সমাজ থেকে এই ব্যাধি দূর করা সম্ভব। সে লক্ষ্যেই ‘বালিকা বধু নয়’ স্লোগানে এই কার্যক্রম চলছে, জানান খুলনার জেলা প্রশাসক মো. মোস্তফা কামাল।
সরষেতেই ভূত:
বাল্যবিবাহ যাঁদের ঠেকানোর কথা, তাঁরাই এর মদদদাতা। এই তালিকায় আছেন জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তি, কাজি ও আইনজীবী। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ প্রবণ ১০টি জেলায় খোঁজ নিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
আরও জানা গেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাল্যবিবাহ রোধে কোনো সফলতা সরকার পাচ্ছে না। সব বিয়ের খবর প্রশাসন পাচ্ছে না। খবর পেলে প্রশাসন যাচ্ছে, বিয়ে ভাঙছে, জরিমানা করছে। কিন্তু কিছুদিন পরই এসব শিশুকে আবার বিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে খবর প্রশাসন রাখছে না।
বাল্যবিবাহের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে দেশের ৬৪ শতাংশ শিশুর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে।
২০১৩ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) বাংলাদেশের বাল্যবিবাহ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দারিদ্র্য, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, বয়স বেড়ে গেলে যৌতুকের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে অভিভাবকেরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফ গত বছর মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশে বাল্যবিবাহ প্রবণ ১০ জেলা হচ্ছে বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, পঞ্চগড়, জামালপুর, কুষ্টিয়া ও খুলনা।
জরিপের সময় বগুড়ায় ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের ৬০ শতাংশ, জয়পুরহাটে ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ, কুড়িগ্রামে ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ, নাটোরে ৫২ দশমিক ২ শতাংশ, নওগাঁয় ৫০ দশমিক ৬ শতাংশ কিশোরী বিবাহিত ছিল।
বাল্যবিবাহ রোধ নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ হলো, যেসব এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার কম, সেখানে বাল্যবিবাহের হার বেশি। বাল্যবিবাহ প্রবণ এলাকায় জন্মনিবন্ধনের হার ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৫৩ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত। একমাত্র কুড়িগ্রাম জেলায় পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের জন্মনিবন্ধনের হার ছিল ৮১ দশমিক ৭ শতাংশ।
গত বছরের নভেম্বরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের স্বর্ণকারপট্টিতে ষষ্ঠ শ্রেণি পড়ুয়া একটি মেয়ের বিয়ে ভেঙে দেয় প্রশাসন। মাস খানেকের মাথায় মেয়েটিকে তার অভিভাবক অন্য জায়গায় নিয়ে বিয়ে দেন। স্বজনেরা জানান, বিয়ে দিতে তাঁরা জন্মসনদ জোগাড় করেছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেয়েটি তালাক দিয়ে ফিরে আসে।
“মেয়েদের বিয়ে নিয়ে দেশে যখন নৈরাজ্যকর একটি অবস্থা চলছে তখন বিয়ের বয়স কমানোর চিন্তাটা পশ্চাৎপদ,” বেনারকে জানান আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, যিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন।
তাঁর মতে, “মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ না রাখলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।”