কেঁদে আর কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন ৬৩ ছিটমহলবাসী

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.11.20
BD-goodbye লালমনিরহাটের একটি গ্রাম থেকে ভারতে নতুন আবাস বেছে নেয়া একটি পরিবার গাড়িতে মালপত্র তুলছেন। ১৯ নভেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

৬৮ বছরের বন্দিপ্রায় জীবন। নিজ দেশে থেকেও ছিল পরবাসী হওয়ার কষ্ট। তবুও আপন হয়েছিল এখানকার প্রতিটি ঘাস, লতাপাতা, প্রকৃতি আর প্রতিবেশিরা। এখন মিলেছে স্থায়ী ঠিকানা, নিজের দেশ। আর সেই দেশে ফিরতে গিয়ে ছিড়তে হল ৬৮ বছরের বাঁধন। বুকের পাজর ভাঙা কষ্টকে সঙ্গী করে কেঁদে আর কাঁদিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে গেলেন বিলুপ্ত ছিটমহলের ৬৩জন বাসিন্দা।

চিরচেনা পরিবেশ, প্রতিবেশী, সেই সঙ্গে যাপিত জীবনের হাজারো স্মৃতিকে পেছনে ফেলে যাওয়ার সময় বারবার আঁছড়ে পড়ছিলেন লালমনিরহাটের সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীদের মধ্যে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়া এসব মানুষগুলোর।

বিদায় নিয়েও যেন যেতে পারছিলেন না তারা। পা তুলে এগুলেই আপন ভূবন হয়ে যাবে ‘অন্যদেশের’। দূরত্ব হবে ভিসা আর পাসপোর্টের। ইচ্ছে করলেই ছোঁয়া যাবে না, ডাক দিলেই পাওয়া যাবেনা কাছের মানুষগুলোকে। আর তাই বৃদ্ধ বাবাকে বিদায় দেওয়ার সময় প্রণাম করে  মেয়ে সৈব্য রানী বলেন, “এটাই বুঝি জীবনের শেষ প্রণাম। মরে গেলেও আর বাবার মুখ দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা জানিনা। ভালো থেকো বাবা, আমাদের আর্শিবাদ করো।”

উত্তর গোতামারী বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ভৈরব চন্দ্র নাগরিকত্ব গ্রহণ করে এক মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ভারতে চলে গেলেন। তবে বাংলাদেশে রেখে গেলেন বিবাহিত দুই মেয়েকে। তাদেরই একজন সৈব্য । যাকে বিদায় দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি।

বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর ভেতর থেকে হাতীবান্ধা উপজেলার ১৩৫ ও ১৩৬ গোতামারী ছিটমহল দুটি থেকে ১৭ পরিবারের ৬০ জন এবং পাটগ্রাম উপজেলার লতামারী ছিটমহল থেকে এক পরিবারের তিনজন ভারত পাড়ি জমান।

গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বিনিময় হয় ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহল। এরপর উভয় দেশে সরকারিভাবে যৌথ জরিপ কার্যক্রম চলে। এ জরিপকাজের মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী নিজেদের ইচ্ছেমতো নাগরিকত্বের আবেদন করেন।

এ সময় লালমনিরহাটের ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে সাতটি ছিটমহলের ১৯৭ জন নারী-পুরুষ ভারতে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। ভারতে নাগরিকত্বের আবেদনকারীদের জন্য ট্রাভেল পাস ইস্যু করে ভারত সরকার। সে অনুযায়ী ট্রাভেল পাসধারীদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ভারত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় উভয় দেশের ডিসি-ডিএম পর্যায়ের যৌথ সভায়। এর অংশ হিসেবেই বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় গেলেন ৬৩ জন।

বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর ভেতর থেকে হাতীবান্ধা উপজেলার ১৩৫ ও ১৩৬ গোতামারী ছিটমহল দুটি থেকে ১৭ পরিবারের ৬০ জন এবং পাটগ্রাম উপজেলার লতামারী ছিটমহল থেকে এক পরিবারের তিনজন ভারত পাড়ি জমান।

গত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বিনিময় হয় ভারত-বাংলাদেশের ১৬২টি ছিটমহল। এরপর উভয় দেশে সরকারিভাবে যৌথ জরিপ কার্যক্রম চলে। এ জরিপকাজের মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী নিজেদের ইচ্ছেমতো নাগরিকত্বের আবেদন করেন। এ সময় লালমনিরহাটের ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে সাতটি ছিটমহলের ১৯৭ জন নারী-পুরুষ ভারতে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন।

ভারতে নাগরিকত্বের আবেদনকারীদের জন্য ট্রাভেল পাস ইস্যু করে ভারত সরকার। সে অনুযায়ী ট্রাভেল পাসধারীদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ভারত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় উভয় দেশের ডিসি-ডিএম পর্যায়ের যৌথ সভায়। এর অংশ হিসেবেই গতকাল প্রথম দফায় গেলেন ৬৩ জন। দ্বিতীয় দলে ১৩৩ জন ২৩ নভেম্বর ভারত যাবেন।

বৃহস্পতিবার ভারতে যাওয়া ৬৩ জনের কেউই স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিতে পারেননি। চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি প্রতিবেশিরাও। চোখের পানিই- একমাত্র ভাষা হয়ে উঠেছিল তাদের। ১৩৫ গোতামারী ছিটমহলের ৮৩ বছরের তারক চন্দ্র বর্মণ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দিতে আসা এক স্বজনকে বলেন, ‘বাবা, আর বুঝি বেশিদিন আমি বাঁচব না। তোমাদেরকে থুয়ে কেমন করে ভারতে থাকব। আমি কি থাকতে পারব?’

তাদেরকে বিদায় জানাতে আসা প্রতিবেশিদের কয়েকজন কান্নাজড়িত গলায় জানান, এমন বিদায় তারা চাননি। প্রতিবেশি হলেও আপনের চেয়ে আপন এসব মানুষগুলো। চলে গেলে শুধু গ্রাম নয়, ফাঁকা হয়ে যাবে বেঁচে থাকার ছোট্ট পৃথিবীটা।

তবে সকল আবেগ সামলে গ্রামকে ফাঁকা করে, কেঁদে এবং অনেককে কাঁদিয়ে বিদায়ী মানুষগুলো বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বুড়িমারী স্থলবন্দরে একত্রিত হন। এর আগে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করা হলেও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাঁচটি ট্রাকে করে ভারতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

১৮ পরিবারের ৬৩ জনের জন্যও যাত্রী পরিবহনকারী বাসের ব্যবস্থা করা হয়। বেলা পৌনে দুইটার দিকে স্থলবন্দরের জিরো পয়েন্ট দিয়ে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন তারা।  বাংলাদেশের সীমান্তের শেষ প্রান্তে যাওয়ার পরও হাত ধরাধরি ও গলা ধরে কাঁদছিলেন অনেকেই। পরিবারগুলো ভারতের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ এলাকার আবাসনে আশ্রয় নেবেন বলে জানা যায়। যাত্রাপথে তাদের নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ ও ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত ছিল।

বুড়িমারি বন্দরে তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় দেন পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর কুতুবুল আলম ও হাতীবান্ধা উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি আজিজুর রহমান ।

তারা ভারতীয় অংশে প্রবেশ করলে সেখানে স্থাপিত তিনটি মঞ্চ থেকে ভারতীয় জাতীয় সংগীত গেয়ে ফুলেল শুভেচ্ছায় মিষ্টিমুখ করিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া হয়। এসময় ভারতের কোচবিহার জেলার নাটাবাড়ীর বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, মেখলিগঞ্জের পরেশ চন্দ্র অধিকারী, কোচবিহার জেলা শাসক পি উলগানাথনসহ ভারতীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে এসব আনুষ্ঠানিকতার পরেও বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর চোখমুখ থেকে বাংলাদেশ আর প্রিয় স্বজন ছেড়ে যাওয়া বেদনার চিহ্নগুলো লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।

স্থানীয় সাংবাদিক খোরশেদ আলম সাগর বেনারকে বলেন, “ব্যক্তিগত আর পেশাগত জীবনে অনেক বিদায় আমি দেখেছি। কিন্তু ছিটমহলবাসীরা  যেভাবে বিদায় নিলেন তা আজীবন আমার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। তাদের কান্না শুধু স্বজন বা প্রতিবেশিদের নয়, ছুঁয়ে গেছে উপস্থিত সাংবাদিক, পুলিশ আর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও। একটু ভাল থাকার আশা নিয়ে তারা ভারতে গেলেও তাদের মন পড়ে থাকবে বাংলাদেশে। দরিদ্র এই মানুষগুলো এদেশকে কতটা ভালবাসে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।