আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হালাল পণ্যের সনদ দিচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.22
BD-halal বিশ্বব্যাপি হালাল খাদ্য ও ভোগ্যপন্যের চাহিদা বাড়ছে। জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

বিশ্ব বাজারে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদ অনেকটা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠায় এবং ক্রমাগত এর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন কয়েকটি পণ্যের হালাল সনদ দেওয়া শুরু করেছে।

তবে পণ্য উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই সনদ নেওয়া এখন পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা হয়নি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস এর ১৮৯তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ-সংক্রান্ত আইন জাতীয় সংসদে অনুমোদন না হওয়া পর্যন্ত ফাউন্ডেশন হালাল সনদ প্রদান করবে।ধর্মমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি পণ্যের এই সনদ দিচ্ছে।

ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে ১৫টি পণ্যকে হালাল সনদ দেওয়া হয়েছে, যা থেকে সরকারের আয় হয়েছে প্রায় দশ লাখ টাকা। এই চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মাংসসহ হালাল খাদ্য, ভোগ্যপণ্য, প্রসাধন সামগ্রী ও ফার্মাসিউটিক্যালস।


“আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছামতো পণ্যকে হালাল বলে ঘোষণা দিচ্ছে।ধর্মীয়ভাবে স্পর্শকাতর হালাল-হারামের বিষয়টি নিয়ে এক ধরণের অনৈতিক কর্মকান্ড চলছিল।এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এগিয়ে এসেছে,” বেনারকে জানান ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল।

তবে এ সব প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে চাননি মহাপরিচালক। ভূয়া প্রতিষ্ঠানের কোনো তালিকা নিয়ে কারো মাথাব্যাথা ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেনো এই প্রশ্নে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি বলেন, আগে তো নিয়ম-নীতি ছিলনা, কে, কী করেছে তার চেয়ে এখন কেউ  নীতি ভাঙছে কিনা, সেটা দেখা হবে।

তাঁর মতে, বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাজারে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে পারছে না শুধু এ ধরণের সনদ প্রদানকারী কোনো সংস্থা না থাকার কারণে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারি একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই, যার মূল কাজ পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করে দেখা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ১৯১তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়, হালাল খাদ্য, ভোগ্যপণ্য, প্রসাধন সামগ্রী ও ফার্মাসিউটিক্যালস-এর হালাল সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে লোগো ও সার্টিফিকেট ফি নেওয়া হবে। এ ছাড়া পণ্যের ফ্যাক্টরি মূল্যের ওপর শতকরা ০.০৮ টাকা (শতকরা ৮ পয়সা) ফি নিয়ে তা সরকারি কোষাগারে জমা করা হবে।

হালাল সনদ দেওয়ার জন্য ফাউন্ডেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মাওলানা আবু সালেহ বেনারকে বলেন, সনদ ও লোগো ফি ছোটবড় কারখানাভেদে ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা হলেও এখন পযর্ন্ত শুধু ফ্যাক্টরি মূল্যের উপর ফি বাবদ শতকরা ৮ পয়সা  নেওয়া হচ্ছে। অচিরেই সনদ ও লোগো ফি নেওয়া শুরু হবে বলে জানান ড. সালেহ।

ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের হিসাবে, প্রতি বছর বিশ্বে হালাল পণ্যের ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে, যেখানে প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ১৬ থেকে ২৫ শতাংশ।

ওই হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে হালাল পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার তিন ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে যা বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের ১৫০ গুণেরও বেশি।

ফাউন্ডেশনের সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, জর্ডান, তুরস্ক, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারতসহ অনেক দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করার জন্য হালাল সনদ দিচ্ছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিক ফাউন্ডেশন সরকারের ২২ টি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়ে এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে এবং এর ভিত্তিতে সনদ দিচ্ছে।

“হালাল সনদ ইস্যুর সঙ্গে ধর্মীয় সম্পৃক্ততা রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনই এখন সরকারের পক্ষে হালাল সনদ ও লোগো প্রদানের একমাত্র স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান,” জানান সামীম মোহাম্মদ আফজাল।

“হালাল সনদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বা প্লেনে পরিবেশনের আগে হালাল খাবারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়,” বেনারকে জানান ড. আবদুল মুনিম খান, যিনি বেসরকারি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগি অধ্যাপক।

ইসলাম বিষয়ে গবেষণা করা ওই লেখক ও শিক্ষক মনে করেন, হালাল সনদ দেওয়ার উদ্যোগটি ভালো, কিন্তু হালালের নামে হারাম খাবার দেওয়া হয় কিনা, সেটি তদারকি করতে হবে কঠোরভাবে।  

সরকারি হিসেবে, এ দেশে শতকরা ৯১ ভাগ মুসলমানের বাস যা পৃথিবীর মোট মুসলমানের ৯ শতাংশ। অবশ্য বাংলাদেশের ভেতরে খাদ্য বা ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের প্রশ্নটি খুব একটা জোরালো নয়।

“এ দেশের প্রায় সব মানুষ বিদেশে হালাল সনদ ও লোগো দেখে পণ্য ক্রয় করতে আগ্রহী।বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও ক্রেতারা এই সনদটি দেখতে চায়, বেনারকে  জানান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক মিশনের পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল।

তাঁর মতে, শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্যান্য মুসলিম দেশ এমনকি অনেক অমুসলিম দেশেও হালাল পণ্যের চাহিদা রয়েছে।

ইসলাম বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে যেসব বিষয়কে বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে, শরিয়তের পরিভাষায় তা হালাল। আর কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে যে সব বিষয়কে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে তা হারাম।

তাঁদের মতে, হালাল খাদ্য গ্রহণ করা এবং হারাম থেকে বিরত থাকা মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করিও না, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’’ (সুরা বাকারা, ২: ১৬৮)।

হালাল সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগের প্রকাশ্য বিরোধিতাকারি নেই। তবে আড়ালে-আবডালে সমালোচোকেরা বলছেন, হালাল সনদ দেওয়ার লক্ষ্যে পণ্য পরীক্ষার জন্য ফাউন্ডেশনের পরীক্ষাগার নেই। নেই কোনো বিশেষজ্ঞ।

এসব অভিযোগের জবাবে সামীম মোহাম্মদ আফজাল জানান, “হালাল-হারাম বিষয়ে মতামত প্রদানের এখতিয়ার কোরআন ও হাদিস বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের এবং ফাউন্ডেশনে সরকার নিযুক্ত এমন অনেক বিশেষজ্ঞ আছেন।

হালাল পণ্য নির্ধারণে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিজস্ব ল্যাব রয়েছে কিনা জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, “আমরা খাদ্যের গুণগত মান দেখি না, পণ্যটি হালাল কি-না তা নিরীক্ষা করি। হালাল সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে পণ্যে কী উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে তা যাচাই করা হয়।”

এরপর কমিটি বিএসটিআই, খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি অধিদপ্তর, পানি সম্পদ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সনদ, পণ্য যাচাই প্রতিবেদন এবং সনদ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের অঙ্গীকারনামা পরীক্ষা করে হালাল সনদ দেয় বলে জানান তিনি।

মহাপরিচালকের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে হালাল খাদ্যের যে চাহিদা রয়েছে, তা যদি যথাযথভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে এর মাধ্যমে দেশে অসংখ্য আলেম-ওলামারও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।  

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।