ব্রেইন ডেথের পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে
2016.03.01
সময়টা ২০১৩। সাত মাস বয়সী লুকাসের মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে। নিরুপায় দিশেহারা হিদার ক্লার্ক তখন মরিয়া যে কোনো উপায়ে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে। সেই ভাবনা থেকেই লুকাসের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তিনি দান করে দিলেন। এর তিন বছর পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার ছোট্ট মেয়ে জর্ডানাকে বুকে চেপে ধরে শুনে নিলেন লুকাসের হৃৎস্পন্দন।
যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকেরা গত বছরের নভেম্বরে দমকল বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্যাট্রিক হার্ডিসনের মুখ প্রতিস্থাপন করেছেন। ১০০ চিকিৎসকের একটি দল ২৬ ঘণ্টা ধরে ওই অস্ত্রোপচারটি করেন।
ব্রুকলিনের ডেভিড রোডবো সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন কোমায় থাকার পর রোডবোর মা মুখমন্ডলটি কাউকে দিয়ে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। ওই মুখমন্ডল দিয়ে অস্ত্রোপচারের ৯৩ দিন পর প্যাট্রিককে সুস্থ ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।
সারা বিশ্বেই এখন মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করে মানবদেহে সংযোজনের পদ্ধতিটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের বিধান রেখে আইনের সংশোধনীর খসড়া গত বছরের ২৯ জুন মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করেছে।
কিছু সংযোজন-বিয়োজনের পর সংশোধনীসহ আইনটি খুব শিগগির পাস হওয়ার কথা রয়েছে। আইনটির নাম হবে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধিত) আইন, ২০১২।
এখন বাংলাদেশে মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯-এর আওতায় জীবিত ব্যক্তিরা তাঁদের কিডনি ও যকৃৎ প্রতিস্থাপনের জন্য দান করতে পারেন। এ ছাড়া মরণোত্তর চক্ষুদানেরও সুযোগ রয়েছে। তবে সংযোজনের জন্য অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান এখনো শুরু হয়নি। ব্রেন ডেথ বা মস্তিষ্কের মৃত্যুর পর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় ‘ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্ট।’
কিডনি, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চামড়া, টিস্যু মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যেকোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের ক্ষেত্রে নতুন এই সংশোধিত আইনটি অনুসরণ করতে হবে।
মূলত ২০১১-১২ সালে জয়পুরহাটের কালাইয়ে জোর করে বা ফুসলিয়ে অভাবী মানুষের কিডনি কেটে নেওয়ার খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশের পর থেকে দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন একরকম বন্ধ আছে। মূলত কিডনি প্রতিস্থাপনটা যেন দ্রুত শুরু করা যায় সে জন্যই কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তবে সংশোধনীটি বিস্তৃত পরিসরে করা হয়েছে। যেন অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজনের ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়তে না হয়।
“বর্তমান আইনেও ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের কথা বলা আছে। এত দিন বিধিবিধান ছিল না। আইনের কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। সংশোধনীটি দ্রুত পাস করা প্রয়োজন,” বেনারকে জানান কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ হারুন অর রশিদ।
“বিষয়টি কিছুটা সংবেদনশীল হওয়ায়, আমরা খুঁটিনাটিগুলো মিলিয়ে দেখছি। কোনো ফাঁকফোকর থাকলে শুভ উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে,” বেনারকে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মো. নুরুল হক।
যা আছে সংশোধিত আইনটিতে
কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা অবিরাম সংজ্ঞাহীন (কোমায়) ব্যক্তি, যার স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস নেই এবং ভেন্টিলেটরের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস সঞ্চালন করা হচ্ছে তাঁরই মস্তিষ্কের মৃত্যু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। তবে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধের কারণে কোমা হলে ৩৬ ঘণ্টা সময় পার না হওয়া পর্যন্ত ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করা যাবে না।
১৮ বছরের ওপরে এবং ৬৫ বছর বয়সের নিচে আগ্রহী ব্যক্তি তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন, তবে তা জীবদ্দশায় লিখে রেখে (উইল) যেতে পারবেন।
কেউ যদি আগে থেকে উইল না করে যান, ব্রেইন ডেথ ঘোষণার পর তাঁর আইনানুগ উত্তরাধিকারী লিখিত অনুমতি দিতে পারেন।
এ ছাড়া কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেউ যদি মৃতদেহ দাবি না করে, সে ক্ষেত্রে মৃতদেহের প্রশাসনিক কর্তৃত্ব (সাধারণত জেলা প্রশাসক) যাঁর ওপর, তিনি বা তাঁর মনোনীত ব্যক্তি অনুমতি দিতে পারবেন।
ব্রেইন ডেথ ঘোষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মেডিসিন, নিউরোলজি অথবা ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনে বিশেষজ্ঞ কমপক্ষে তিনজন চিকিৎসককে। তাঁরা যৌথভাবে ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করবেন।
এর বাইরে যে হাসপাতালে রোগী চিকিৎসাধীন থাকবেন, সেই হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করবে। প্রয়োজনে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের একই মর্যাদাসম্পন্ন কমিটির মতামত নিতে হবে।
তবে ব্রেইন ডেথ যে চিকিৎসকেরা ঘোষণা করবেন, তিনি বা তাঁর স্বজনেরা কোনোভাবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না।
কোনো পক্ষ মিথ্যা তথ্য দিলে তাঁর দুই বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও এ আইনে রাখা হয়েছে।
বিশ্বে জনপ্রিয় ক্যাডাভেরিক ট্রান্স প্ল্যান্টেশন
আশির দশকের শুরুর দিকে সৌদি আরবে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনে আইন করা হয়। দেশটির ইসলামিক কাউন্সিল (জ্যেষ্ঠ ওলামাদের কমিশন) জীবন্ত ও মৃত মানুষের দেহ থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহে কোনো বাধা নেই বলে সিদ্ধান্ত দেয়। সৌদি আরবে এখন ৮০ ভাগ প্রতিস্থাপন হচ্ছে মস্তিষ্কেও মৃত্যু ঘটেছে এমন মানুষের কাছ থেকে।
১৯৮৫ সাল থেকে ভারতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে উৎসাহ দিতে কাজ করছে গণদর্পন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাটির প্রধান গত বছর বাংলাদেশ সফর করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি একজন যুবকের ছবি দেখান। ব্রেইন ডেথের পর ওই যুবকের ৩৬ টি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বহুজনার কাজে এসেছে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশে গণদর্পণের আদলে মৃত্যুঞ্জয় নামের একটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। তবে এর কার্যক্রম ব্যাপক ভিত্তিতে এখনো শুরু হয়নি।
“মানুষ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে উদ্বুদ্ধ হবে তখনই যখন চিকিৎসকেরা নিজেদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের ঘোষণা দেবেন। এতে সাধারণ মানুষের ভয় ভেঙে যাবে। তাঁরা স্বচ্ছন্দে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের বিষয়ে সম্মতি দেবেন,” বেনারকে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগের প্রধান মানজারে শামীম।