সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে আরেকধাপ অগ্রগতি
2015.03.25
বাংলাদেশে পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ নিউমোনিয়া হলেও এর টিকা সরকার ও সহযোগিদের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচীর বাইরে ছিল । অথচ পাঁচ বছরের নিচে মারা যাওয়া মোট শিশুর এক-পঞ্চমাংশ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
সরকারি হিসেবে, একবছর পূর্ণ হওয়ার আগে নিয়মমাফিক সবগুলো টিকা নেয়া শিশুদের হার বর্তমানে ৮৫ শতাংশ। এই সাফল্যের ফলে আরও পাঁচটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্গ ডা আমজাদ হোসেন বেনার নিউজকে বলেন, “এতদিন বেসরকারীভাবে এই টিকা দেওয়া হতো। এটা খুবই কাযর্কর টিকা। দাম ৭০০-৮০০ টাকা। সবাই এটা কিনতে পারত না। সনোফি এভেন্টিস এর টিকা আমরা প্রেসক্রাইব করি”।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ২১ মার্চ ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নিউমোনিয়ার টিকা পিসিভি ও পোলিও ইঞ্জেকশনের উদ্বোধন করেন ।
"এসব রোগের টিকা চালুর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের পরিকল্পনায় ছিল। পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ২০১৩ সালে দেশে টিকা সংরক্ষণের সক্ষমতা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়," জানান মোহাম্মদ নাসিম।
তিনি বলেন, নিউমোনিয়ার টিকা দেয়ার ফলে এ রোগ থেকে শিশুদের রক্ষা করা যাবে। একই সঙ্গে শিশুমৃত্যুও অনেক কমে যাবে।
বাংলাদেশে বিনা মূল্যে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে সহযোগিরা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, নিউমোনিয়ার টিকা ও পোলিও টিকার ইনজেকশন চালু হলে বাংলাদেশের ৩০ লাখ শিশু এর সুফল পাবে । সহযোগিরা হচ্ছে দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমুনাইজেশন (গ্যাভি), ইউনিসেফ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও গ্লোবাল পোলিও ইরাডিকেশন ইনিশিয়েটিভ (জিপিইআই) ।
"বাংলাদেশের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে ২২ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া। এ রোগের টিকা চালু হলে শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে," বিবৃতিতে জানান গ্যাভির প্রধান নির্বাহী ডা. সেথ বার্কলে ।
নিয়মিত টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বীকৃতি হিসাবে বাংলাদেশ দুইবার পেয়েছে ‘গ্যাভি বেস্ট পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড।
উল্লেখ্য, নিউমোনিয়ার টিকার পাশাপাশি পোলিওর টিকায় আনা হয়েছে পরিবর্তন। মুখে খাওয়ানোর টিকার পরিবর্তে যোগ হয়েছে পোলিওর ইনজেকশন। বাংলাদেশে এতোদিন পোলিওর মুখে খাওয়ানোর টিকা ব্যবহার করা হলেও আন্তর্জাতিকভাবেই এ টিকার ইনজেকশন চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এতদিন টিকাদান কর্মসূচীর আওতায় পোলিও, যক্ষা, হুপিং কাশি, ধনুষ্টংকার, ডিপথেরিয়া, হেপাটাইটিস বি, হাম-রুবেলা এবং হেমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক টিকা দেয়া হত।
"আমাদের দেশে ৯টি টিকা চালু আছে। এর সঙ্গে পোলিও টিকার ইনজেকশন ভার্সন আইপিবি এবং নিউমোনিয়ার টিকা পিসিভি নামে আরও নতুন দুটি টিকা চালুর ফলে একদিকে শিশু মৃত্যুর হার কমে আসবে, আরেক দিকে পোলিও রোগের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না," বেনারকে জানান প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচির পরিচালক ডা. কামরুল ইসলাম ।
১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচী শুরু হয়। এর আওতায় বড় বড় হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে প্রতি ১০০ জনে মাত্র ২ জন শিশুকে টিকা দেয়া সম্ভব হতো। তাই ১৯৮৫ সালে প্রত্যেক শিশুকে এই কর্মসূচীর আওতায় আনতে নতুন কৌশল নির্ধারণ করা হয়।
এতে এক বছরের কম বয়সী শিশুদের সকল টিকা নিশ্চিত করতে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচী সম্প্রসারণ করা হয়। পাশাপাশি নবজাতককে ধনুষ্টংকার থেকে রক্ষা করতে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সন্তান ধারনক্ষম মেয়েদের টিটি টিকা দেওয়া শুরু হয়।
এক বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্মের পরপরই যক্ষা থেকে রক্ষা করতে বিসিজি টিকা দেয়া হয়। ৬ সপ্তাহ বয়সে ডিপথেরিয়া, পাটুসিস, টিটেনাস, হেপাটাইপিস বি ও হেমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জাএই পাচঁ রোগ প্রতিরোধের টিকার প্রথম ডোজটি দেয়া হয়। এরপর ১০ সপ্তাহে দ্বিতীয় ও ১৪ সপ্তাহ বয়সে তৃতীয় ডোজটি দেয়া হয়। এরসঙ্গে হাম-রুবেলার টিকাটি (এমআর) নয় মাস বয়সের পরে দেয়া হয়।
" এরপর শুধু রোবেলা প্রতিরোধের টিকাটি ১৫ মাস বয়সে দেয়া হয়ে গেলে বলা যাবে, শিশু সব টিকা পেয়ে গেছে," জানান প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচির পরিচালক।
পোলিও নির্মূলে নতুন ভাবনাঃ
পোলিও টিকা মুখে খাওয়ানো হলে মাঝে মধ্যে শিশুর এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দেখা যায়। কিন্তু ইনজেকশন আকারে এ টিকা দেওয়া হলে সেই ঝুঁকি থাকে না, যদিও এর খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি।
২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল পরিকল্পনার অংশ হিসাবে পোলিও টিকার ইনজেকশন চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশকে গতবছরই পোলিওমুক্ত ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে এ অবস্থা ধরে রাখার জন্য টিকাদান কর্মসূচিতে পোলিও টিকা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
সরকার বলছে, পাকিস্তানে এখনও পোলিওর প্রকোপ থাকায় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত থাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য পোলিও ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
"বর্তমানে দেশ পোলিওমুক্ত হলেও আমাদের এটা ধরে রাখতে হবে", জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী । নির্দিষ্ট বয়সী সকল শিশুই যেন টিকা নিতে পারে, সেজন্য ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সকলকে সচেতন করার আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী ।