পশ্চিম বাংলায় আবার ইলিশ রফতানীর সম্ভাবনা

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.08.17
BD-hilsha বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আবার ইলিশ রফতানীর খবরে উল্লসিত পশ্চিম বাংলার ভোজন রসিকরা। আগষ্ট,২০১৫
বেনার নিউজ

বর্ষা এসেছে অনেক দিন হলো। কিন্তু,  জলের যে রুপোলি শস্যের অপেক্ষায় বর্ষার পথ চেয়ে থাকে বাঙালি,  সেই ইলিশ মাছ এখনও পশ্চিমবঙ্গের বাজারে কার্যত অধরা।

দমদমের বাসিন্দা সুজাতা চক্রবর্তীর গলায় আফসোস ঝরে পড়ল। বললেন,  ‘‘দেড় কেজি বা তার চেয়ে বড় মাপের ইলিশের স্বাদ তো ভুলতেই বসেছি। এখন বাজারে যে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে,  সেগুলো খুব বেশি হলে চারশো-সাড়ে চারশো গ্রাম সাইজের। তবে, নামেই ইলিশ। স্বাদ, গন্ধ, তেল, কোনওটাই নেই।’’

জুন মাসের গোড়ায় বাজারে ইলিশের দেখা মিলেছিল। সুন্দরবন উপকূল দিয়ে বঙ্গপোসাগর থেকে রায়দিঘি, ক্যানিং, কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবারে ঢুকেছিল ইলিশের এক বিরাট ঝাঁক। স্বাদ-গন্ধে চমৎকার। ফলে আশা জেগেছিল, এই বছর বুঝি বাঙালির পাত জুড়ে রাজত্ব করবে সুস্বাদু ইলিশ। কিন্তু সেই আশায় ছাই দিয়ে উধাও হয়েছে ইলিশের ঝাঁক। মৎস্যজীবীদের ট্রলার ফিরছে কার্যত খালি হাতেই।

কেন জালে পড়ছে না ইলিশের ঝাঁক,  সে বিষয়ে বেশ কয়েকটি মতামত শোনা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ গবেষণাকেন্দ্রের অধিকর্তা সপ্তর্ষি বসু জানালেন,  ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর পুবালি বাতাস না পেয়েই পথ পরিবর্তন করেছে ইলিশের ঝাঁক। সম্ভবত চলে গিয়েছে বাংলাদেশের দিকে। আবার,  কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির গবেষক, পরিবেশবিদ জয়দীপ মল্লিকের মতে,  সমুদ্রে দূষণের পরিমাণ বাড়ায় ইলিশের ঝাঁক আরও গভীর জলে চলে যাচ্ছে। সেই গভীরতায় সম্ভবত জাল পৌঁছোচ্ছে না।

পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ অন্য একটি আশঙ্কার কথা বলছেন। তাঁর মতে, অকালে ছোট মাপের ইলিশ ধরার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। মৎস্যজীবীদের বারংবার মানা করা সত্ত্বেও তাঁরা চটজলদি লাভের আশায় একেবারে ছোট মাপের ইলিশও ধরেছেন। ফলে, এখন আর বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

একই মত নাগেরবাজারের মাছের ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ মণ্ডলের। বললেন, এখন রূপনায়ারণ বা রায়দিঘির ছোট ইলিশই ভরসা। নয়তো, মায়ানমার থেকে আমদানি করা বহু দিন ধরে বরফে থাকা ইলিশ খেতে হবে, যাতে স্বাদ বলে বিশেষ কিছু আর থাকে না।

সংবাদসূত্রে প্রকাশ, ২০১২ সালের আগে বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৬০০০ টন ইলিশ আমদানি করত ভারত। সেই ইলিশের আমদানি বন্ধ হওয়ায় এখন মায়ানমার থেকে বছরে ৮০০ টন আসে। কয়েক বছর আগেও দেড় থেকে দু’কেজির ইলিশ মিলত পাইকারি বাজারে। এখন সেই মাপের মাছ পেতে গেলে ফের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের ইলিশের প্রতি পশ্চিমবঙ্গের টান চিরকালীন। অনেকেই বলেন, পদ্মার ইলিশের স্বাদ এ পার বাংলার মাছে পাওয়া অসম্ভব। কাজেই,  বাংলাদেশ থেকে মাছ আসার খবর পেলে কলকাতার অনেকেরই জিভে জল আসবে,  সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশ থেকে আশার আলোর একটা আভাস পাওয়া গিয়েছে। এখনও সে দেশ থেকে ইলিশ রফতানি বন্ধ। ২০১২ সাল থেকে ইলিশ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সে দেশের সরকার। ইলিশের জোগান কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেই সমস্যা হচ্ছিল। সেই কারণেই পশ্চিমবঙ্গে মাছ পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

সেই নিষেধাজ্ঞায় মন ভেঙেছিল এ পারের ভোজনরসিকদের। বাংলাদেশের সঙ্গে সরকারি স্তরের আলোচনায় তাই বারংবার ফিরে এসেছে ইলিশের প্রসঙ্গ। এ বছর জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরে সঙ্গী হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভার খাদ্যতালিকায় ইলিশের উপস্থিতিই ছিল প্রধান। সেখানেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ইলিশ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে অনুরোধ করেন।

সফরের পর গত জুন মাসে বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানিয়েছিলেন, তাঁরা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করছেন। গত ১২ অগস্ট বাংলাদেশের অর্থনীতি বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটি ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রফতানি নীতির রূপরেখা ঘোষণা করে।  সেই নীতি বলছে,  চিনি এবং ইলিশ রফতানির ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। তবে,  সিদ্ধান্তটি এখনও প্রধানমন্ত্রীর সম্মতিসাপেক্ষ। ফলে,  রফতানি অবাধ হবে না,  তাতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকছে। জানানো হয়েছে,  ইলিশ রফতানি করতে হলে আগে বাণিজ্য  মন্ত্রনালয়ের অনুমতি নিতে হবে। বাণিজ্য দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে,  ইলিশ রফতানির অনুমতি দেওয়ার আগে দেশে চাহিদা-জোগানের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখা হবে। (তথ্যসূত্র: ডেইলি স্টার)

এই সিদ্ধান্তে পশ্চিমবঙ্গের ইলিশবিলাসী বাঙালি নিশ্চিত ভাবেই উল্লসিত। কিন্তু, কলকাতার ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের  অর্থনীতিবিদ শুভনীল চৌধুরী একটি আশঙ্কার কথা শুনিয়ে রাখলেন। বললেন, সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ থেকে যাওয়ার অর্থ,  ইলিশ রফতানির ওপর বিভিন্ন কূটনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়বে। যেমন, তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে যদি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন টানাপড়েন তৈরি হয়, তাতে ইলিশের জোগান হঠাৎ থমকে যাবে বলেই আশঙ্কা। ফলে,  এখনই খুব বেশি নিশ্চিন্ত না হওয়াই ভাল।

তবুও, আশায় দিন গুনছে বাঙালি। পদ্মার ইলিশের স্বাদ তার খাবার টেবিলে পৌঁছোবে। আজ না হোক, কাল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।