স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন আইএস নেই, অথচ আইএস অভিযোগে মামলা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.24
BD-is মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠনের আইএসের সন্দেহভাজন সমন্বয়ক সাফায়াতুল কবিরসহ চার সদস্যের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় আদালতে অভিযোগ গঠন হয়েছে।
বেনার নিউজ

বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গি আছে কী নেই, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘লুকোচুরি’ চলছে। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী ও সরকারি দলের শীর্ষ নেতারা বলে আসছেন, দেশে আইএস জঙ্গি নেই।

আবার গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের আইএস জঙ্গি বলে পরিচয় দেওয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় ‘আইএসের সমন্বয়ক’ সাফায়াতুল কবীরসহ চার সন্দেহভাজন জঙ্গির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ওই আইনে মামলা করতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়।

আইএস জঙ্গি নেই বলে সরকারের দাবি এবং আইএস পরিচয়ে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়টি স্ববিরোধী বলে মন্তব্য করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ।

“আমার মনে হয়, বিষয়টি নিয়ে সরকারের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে,” জানান মহিউদ্দিন।   

তবে দেশে আইএসের কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা নেই বলে আবারও দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। সচিবালয়ে গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

“আমি খুব জোর গলায় বলব, আমাদের দেশে সাংগঠনিকভাবে আইএস ধরনের কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। এখানে কিছু কিছু জঙ্গিরা জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামেসহ নানান নামে মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। এখন আর সেই ধরনের সংগঠন কিংবা সে ধরনের কেউ নেই।”

আসাদুজ্জামান বলেন, “এগুলোর যদি গোড়া খুঁজতে যান, তা হলে দেখবেন তাদের উৎপত্তিটা জামায়াত-শিবির।” তা হলে কি আইএস ও জামায়াত এক—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি তো বললামই, তারা নানা নামে, নানাভাবে আসছে।”

আইএস সম্প্রতি তাদের নিজস্ব সাময়িকী দাবিক-এর সর্বশেষ সংখ্যার একটি নিবন্ধে জামায়াতে ইসলামীকে ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করেছে, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তা হলে কী করে আইএস ও জামায়াত এক হয়—এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এই মুহূর্তে কে কার সঙ্গে আছে, আমি ঠিক জানি না। আমি বলছি, গোড়াটা এক। গোড়াটা হলো জামায়াত-শিবির।”

জামায়াত নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।


আইএস জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

‘আইএসের সমন্বয়ক’ সাফায়াতুল কবীরসহ চার সন্দেহভাজন জঙ্গির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার ৪ নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. রুহুল আমিন অভিযোগ গঠন করেন।

এর মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হলো। আদালত আগামী বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেছেন।

“মামলার এজাহার ও অভিযোগপত্রে আসামিদের আইএসের সক্রিয় সদস্য বলা হয়েছে। আসামিদের কাছ থেকে এ-সংক্রান্ত ভিডিওসহ আনুষঙ্গিক আলামত জব্দ করেছে পুলিশ। সাক্ষ্য গ্রহণের সময় তা আদালতে উপস্থাপন করা হবে,” সাংবাদিকদের জানান সংশ্লিষ্ট আদালতের সরকারি কৌঁসুলি এ বি এম বসির উদ্দিন মিঞা।

মামলার অভিযুক্ত অপর তিন আসামি হলেন আনোয়ার হোসেন, মো. রবিউল ইসলাম ও নজরুল ইসলাম।

যাত্রাবাড়ী থানায় করা এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক এ কে এম কামরুল আহসান গত ১৫ মে আদালতে চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, “আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ, জব্দকৃত আলামত, সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রমাণিত হয়েছে যে উল্লিখিত আসামিরা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সক্রিয় সদস্য। এক নম্বর আসামি শাফায়াতুল কবীর জেএমবির আঞ্চলিক সমন্বয়ক”।

আরো বলা হয়, সে পাকিস্তান হতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে জেএমবির পাশাপাশি আইএসআইএসের (ইসলামিক এস্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া) সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছে। তারা জেএমবি ও আইএসআইএসের মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে পরস্পর যোগসাজশে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গোপনে বিভিন্ন ভিডিও প্রদর্শন ও জিহাদি লিফলেট বিতরণ করেছে।

গত ৩০ মার্চ সাফায়াতুল কবীর, আনোয়ার হোসেন ও রবিউল ইসলাম ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন। আদালত তা নাকচ করে দেন।


গত ১৫ অক্টোবর আসামি আনোয়ার হোসেন তাঁর জামিন আবেদনে উল্লেখ করেন, “যেহেতু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাই আসামি কোনো সন্ত্রাসী বা আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী কোনো অপরাধ সংঘটিত করেনি।”

আদালত এই জামিনের আবেদন নাকচ করে আদেশে বলেন, নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, আসামি আনোয়ার হোসেন সাক্ষীদের মোকাবিলায় স্বীকার করেন যে এই আসামিসহ অন্যান্য আসামি নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবির সক্রিয় সদস্য। তাঁরা বাংলাদেশে অবস্থান করে মধ্যপ্রাচ্যের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইএসের দিকনির্দেশনা মোতাবেক সদস্য সংগ্রহের জন্য বৈঠক করাকালীন তাঁদের আটক করা হয়েছে।

মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১৪ জনকে। তাঁদের মধ্যে ডিবির উপপরিদর্শক মশিউর রহমান, সাইফুল ইসলাম, সহকারী উপপরিদর্শক মো. নজরুল ইসলাম, কনস্টেবল খন্দকার মাসুদ আলী, মো. জিয়াউর রহমান ও বিপ্লব কুমার দে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে (১৬১ ধারায়) বলেছেন, আসামিরা জেএমবি ও আইএসের সক্রিয় সদস্য।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৮ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার খানবাড়ি চৌরাস্তায় মো. খানের বাড়িতে জেএমবির আঞ্চলিক সমন্বয়ক শাফায়াতুল আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএসের দিকনির্দেশনা মোতাবেক সদস্য সংগ্রহের জন্য গোপনে বৈঠক করছিলেন।


ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন জেলে

আইএসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ইবনে হামদান জেলে আছেন। কয়েকদফা আবেদন করলেও হাইকোর্ট তাঁকে জামিন দেননি।

গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে হামদানকে গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়।

তার কয়েক দিন আগে রাজধানী থেকে মো. আসিফ আদনান (২৬) ও মো. ফজলে এলাহী তানজিল (২৪) নামের দুই যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আসিফের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরে হামদানকে আটক করা হয়।

মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, হামদান গত বছরের ২৭ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গুলশানের আবাসিক হোটেল ‘মেজবান’- এ ‘আরা হামদান’ পরিচয়ে অবস্থান করেন বলে হোটেলের রেজিস্ট্রারের দেখা গেছে।

হামদান একাধিক বার মরক্কো, মৌরিতানিয়া ও তুরস্ক হয়ে সিরিয়া যান বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিরিয়ায় নুসরা ব্রিগেডে সদস্য হয়ে কথিত জিহাদে অংশ নেন তিনি। জিহাদে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে তিনি এক বন্ধুসহ লন্ডন থেকে তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যান।

মূলত আইএস ও নূসরা ব্রিগেডের জন্য সদস্য সংগ্রহের বিষয়ে আসিফ আদনানসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনার জন্য গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক থেকে বাংলাদেশে আসেন হামদান।


পুলিশের অবস্থান পরিবর্তন

এই দুটি মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় মোট ২২ জন জঙ্গি জেলে আছে, যাঁদের গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ তাদের পরিচয় দিয়েছিল আইএস জঙ্গি হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেশে আইএস জঙ্গি নেই বলে বক্তব্য দেওয়ার পর, পুলিশ এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে।

এর আগে পুলিশ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর অধিকাংশ আসামিকে আইএসের নেতা বা কর্মী বলে দাবি করত। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ কারও বেলায় এমন পরিচয় দেয়নি।

গত ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশকে ‘আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মত’ ব্যবহার করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া হত্যা ও হামলার পেছনে আইএস বা জঙ্গি গোষ্ঠী থাকার স্বীকারোক্তি দিতে ‘চাপ’ আসছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চায়। আফগানিস্তান, পাকিস্তান বানাতে চায়। যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে।”

বাংলাদেশকে ‘যে কোনোভাবে অনিরাপদ’ প্রমাণ করার জন্য ‘আর্টিফিশিয়াল’ বিভিন্ন হত্যা-হামলা ঘটানো হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।