ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে জেএমবি
2015.03.27
কথিত মামুনসহ ৪ জঙ্গীকে ২৬ মার্চ দিবাগত রাত দুইটায় র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটেলিয়ান (র্যাব) গ্রেপ্তার করেছে। তারা নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা। স্ত্রী গর্ভবতি থাকার মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে রাজধানীর উত্তরায় একাকী বাসা ভাড়া নেন জঙ্গী মামুন (প্রকৃত নাম রাজ্জাক হায়দার)। আগামী এপ্রিলে স্ত্রী ও নবজাতককে বাসায় নিয়ে আসার কথা বলেছিলেন তিনি।
ঢাকার উত্তরার কসাইবাড়ির পূর্ব মোল্লারটেকের প্রেমবাগান এলাকায় ওই বাসা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এঁরা হলেন, জেএমবি’র চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা আমীর ও এহসার সদস্য আব্দুর রাজ্জাক হায়দার (৩৫), জেএমবি’র নওগাঁ জেলার আমীর ও গায়রে এহসার সদস্য জিয়াউল বারী ওরফে ডালিম (৩২), জেএমবি’র দিনাজপুর জেলার আমীর ও এহসার সদস্য কোরবান আলী ওরফে মো. আলী ওরফে হাঞ্জালা (৫৫) এবং জেএমবি’র রংপুর জেলা শাখার অর্থ সম্পাদক ও গায়রে এহসার মোফাজ্জল হোসেন।
এহসার ও গায়রে এহসার জেএমবি’র মাঝারি ও নিম্ন মাঝারি স্তরের সাংগঠনিক পদবী।এদের বয়স ৩২ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে।
এসময় ওই বাসা থেকে একটি আরজেস গ্রেনেড, ১২টি পেট্রল বোমা, ৩৪টি অবৈদ্যুতিক ডেটোনেটর, ১৪টি বৈদ্যুতিক ডেটোনেটর, ৩০ মিটার করডেক্স, দুই কেজি পাঁচশ গ্রাম স্প্লিন্টার, ৫০০ গ্রাম গান পাউডার, ৩০টি ছোট-বড় ককটেল, এক কেজি প্লাস্টিক বিস্ফোরক দ্রব্য, ৫০০ গ্রাম সালফিউরিক এসিড, একটি ডেটোনেটর বক্স, প্রায় দুই কেজি কাচের মার্বেল, এক বান্ডিল বৈদ্যুতিক তার এবং বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় জেএমবি। এরপর সরকার সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান ও অন্যতম শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব নেতাকে গ্রেপ্তার করে। ২০০৭ সালে শীর্ষ ছয় নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
তখন সংগঠনটি বিপর্যস্ত হলেও গত কয়েক বছরে জেএমবির মধ্যম ও নিচের সারির অনেকেই ওদের জিহাদ ও খিলাফতের ভ্রান্ত আদর্শ ঠিক রেখে ভিন্ননামে গড়ে ওঠা জামায়াতুল মুসলেমিন ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেন।
সাম্প্রতিক সময়ে জেএমবি আবারও সংগঠিত হয়ে নিজ পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। গত মাসছয়েক ধরে গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গীদের বেশিরভাগই জেএমবির সঙ্গে যুক্ত।
“গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তাঁরা জেএমবিকে পুনরায় সংগঠিত ও শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিল। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে তারা রাজধানীতে বড় ধরনের নাশকতা করারও পরিকল্পনা করে,” বেনারকে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতী মাহমুদ খান।
র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ২৭ মার্চ বলা হয়, গত ১ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসব বিস্ফোরক দ্রব্য উত্তরার ওই বাসায় জমা করা হয়। তাঁরা নাশকতা সৃষ্টির জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে ব্যর্থ হয়।
হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও র্যাব সদরদপ্তর থেকে যানবাহনে ওই বাসাটির দুরত্ব প্রায় ১০ মিনিট।
“গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা ওই বাসায় অভিযান চালাই। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।এ ছাড়া জেএমবি’র অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে,” সংবাদ সম্মেলনে জানান অভিযানে অংশ নেওয়া র্যাব-১০ এর কর্মকর্তা মেজর তৌফিকুল বারী।
শেষরাতে ওই অভিযানের সময় উপস্থিত একাধিক সাংবাদিকের বর্ণনা অনুযায়ী, রাত ৩টার কিছু পরে ওই বাসায় গিয়ে তারা দেখতে পান, টিনের ছাদের এক তলা বাড়ির দুটি কক্ষে থাকতেন জেএমবি সদস্যরা। একটি কক্ষে একটি কাঠের চৌকির ওপর উদ্ধার করা বিস্ফোরকগুলো রাখা ছিল। পাশের কক্ষের দেওয়ালে ঝুলছিল একটি সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা।
বাসার রান্নাঘরে গিয়ে তাঁর দেখতে পান হাড়িতে ভাত ও পাশে মুরগির তরকারি। মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল চাল, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা।
“মাসখানেক আগে গ্রেপ্তারকৃতদের একজন নিজেকে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে সাত হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া নেন। ভাড়াটিয়া নিজেকে মামুন বলে পরিচয় দেন,” বেনারকে জানান গৃহকর্তী হুসনে আরা বেগম। তাঁর স্বামী আবদুর রউফ বাংলাদেশ বিমানের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা ।
হুসনে আরা দম্পতি তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে পাশেই একই ধরনের একটি আধাপাকা বাসায় থাকেন। ব্যক্তিগত তথ্য যাচাই-বাছাই না করে বাসা ভাড়া দেওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি।
হুসনে আরা আরো জানান, র্যাব সদরদপ্তরে কর্মরত মো. সাইফুল ইসলাম মামুন নামের এক কর্মকর্তা গত জানুয়ারি থেকে ওই বাসায় থাকতেন। দুই মাস পরিবার নিয়ে থাকার পর তিনি ওই বাসা ছেড়ে দিলে মার্চ থেকে ওই জঙ্গী বাসাটি ভাড়া নেন।
“বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারলেও জঙ্গীদের মূল লক্ষ্য কখনোই পূরণ হবে না,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক কাজী নূরুল ইসলাম।
তাঁর মতে, জিহাদ বা জঙ্গিবাদের প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষ তথা ৯০ শতাংশ মুসলমানের কোনও সমর্থন নেই।