ঢাকায় আবার ব্লগার খুন, ২ জনকে ধরল জনতা
2015.03.30
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে সোমবার প্রকাশ্যে দিনের বেলা ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যিনি ফেইসবুক ও অনলাইনে লেখালেখি করতেন।
তেজগাঁও পুলিশের উপ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, সোমবার সকালে বেগুনবাড়ি এলাকার দীপিকার মোড়ে এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই দুই মাদ্রাসাছাত্রকে ধরে পুলিশে দিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুটি রক্তাক্ত চাপাতি।
ওয়াশিকুরের ক্ষেত্রেও গলার ওপরের অংশ, মুখ ও মাথা ছিল হামলাকারীদের লক্ষ্যবস্তু, যেভাবে এর আগে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ, ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার, এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলন ও লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছিল।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের এক মাসের মাথায় আবারও একজন ‘অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট’কে হত্যা করা হলো।
বিপ্লব কুমার সরকার জানান, বেগুনবাড়ি এলাকার দীপিকার মোড়ের কছে একটি বাসায় সাবলেট থাকতেন ওয়াশিকুর।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে বাসার কাছেই রাস্তার মধ্যে তিনজন চাপাতি নিয়ে ওয়াশিকুরের ওপর হামলা চালায়। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
লাশের সঙ্গে পাওয়া ভোটার পরিচয়পত্র ও আটক দুই মাদ্রাসাছাত্রের বক্তব্য শুনে ওয়াশিকুরের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার দুই হামলাকারীর মধ্যে জিকরুল্লাহ নামের একজন চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসার ছাত্র। আর আরিফুল নামের অন্যজন পড়েন মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসায়। তারা পুলিশকে বলেছেন, আবু তাহের নামে আরেকজন তাদের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।যে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
উপ কমিশনার বিপ্লব কুমার সাংবাদিকদের বলেন, “ধর্মীয় মতাদর্শ নিয়ে লেখালেখির কারণে বিরোধ থেকে ওয়াশিকুরকে হত্যার কথা গ্রেপ্তার দুজন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে। তারা কোনো সংগঠন বা দলের কি-না তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।”
গাড়ির একজন চালক মোহাম্মদ রফিক বেনার নিউজকে বলেন, “ঘটনার সময় রহমান “ডাকাত, ডাকাত” বলে চিৎকার করলে লোকজন দৌড়ে ২ জনকে ধরে ফেলে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। কয়েকজন হিজড়া সহ কাছে অনেকে জড়ো হয়ে জানতে চাইছিলো কি ঘটনা? আমি বলি তাদেরকে 'ডাকাত চলেন ধরি ওদেরকে', এরপর আমরা ওদের ২ জনকে ধরে ফেলি”।
পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৭ বছর বয়সী ওয়াশিকুর তেজগাঁও কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। তার বাবার নাম টিপু সুলতান, বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামে।
সামহোয়্যারইন ব্লগে ‘বোকা মানব’ নামে একটি অ্যাকাউন্ট থাকলেও তিনি মূলত লেখালেখি করতেন ফেইসবুকের কয়েকটি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে।
এসব ফেইসবুক পৃষ্ঠায় ধর্ম, বিজ্ঞান এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বিভিন্ন লেখা এসেছে বিভিন্ন সময়ে। অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদে তিনি নিজের ফেইসবুক পৃষ্ঠার ব্যানারে লিখেছিলেন- ‘#আইঅ্যাম অভিজিৎ। ওয়ার্ডস ক্যাননট বি কিলড।’
জিকরুল্লাহ ও আরিফুলকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রোববার হাটহাজারি থেকে ঢাকায় আসে জিকরুল্লাহ। কীভাবে কী করা হবে সে বিষয়ে রোববারই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।
“সকালে ওয়াশিকুর বাসা থেকে বেরিয়ে পাঁয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পেছন থেকে তার ওপর হামলা চালায় তিনজন। পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ দুজনকে গ্রেপ্তার করে।”
ঘটনাস্থলে লাশের পাশেই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি রক্তাক্ত চাপাতি পাওয়া যায়। ওয়াশিকুরের বাঁ গাল, মুখ ও চোখ গভীর আঘাতের রক্তাক্ত ক্ষত।
রাস্তার যে অংশে তার ওপর হামলা হয়, তার এক পাশে টেক্সটাইল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার প্রাচীর। অন্যপাশে আরেকটি ভবন। প্রায় দশ ফুট চওড়া রাস্তার ঠিক ওই অংশে কোনো দোকান নেই। ঘটনার সময় ওই রাস্তায় লোকজনও খুব একটা ছিল না।
ওয়াশিকুরের বাসা থেকে হত্যাকাণ্ডের স্থানে পৌঁছাতে গজ পঞ্চাশেক হাঁটতে হয়। তার আগেই একটি মুদি দোকান ও একটি ফার্মেসি রয়েছে। ফার্মেসি থেকে ঘটনাস্থল দেখা যায়। ঘটনার সময় সেটি খোলা থাকলেও পরে দোকান মালিক ঝাঁপ ফেলে চলে যান বলে স্থানীয়রা জানান।
খোকন জেনারেল স্টোরের মালিকের ছোট ভাই জিয়াউদ্দিন জানান, সকালে হঠাৎ নারীকণ্ঠে চিৎকার শুনে তিনি ও দোকানে থাকা কয়েকজন খদ্দের বেরিয়ে এসে দেখেন, রক্তাক্ত অবস্থায় একজন রাস্তায় পড়ে আছেন এবং তা দেখে এক নারী চিৎকার করছেন। আর তিন যুবক দৌঁড়ে মূল রাস্তার দিকে পালানোর চেষ্টা করছে।
বারেক নামে আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তিন হামলাকারী পালানোর সময় কয়েকজন হিজড়া দুইজনকে জাপটে ধরে। পিছন থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা এগিয়ে গিয়ে দুইজনকে আটক করে। পরে পুলিশ এলে তাদের হস্তান্তর করা হয়।
মাত্র এক মাস আগে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হামলাকারীদের চাপাতির আঘাতে আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা, যিনি নিজেও একজন ব্লগার।
ওই ঘটনায় অভিজিৎকে ফেইসবুকে হুমকিদাতা ফারাবী শফিউর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলেও পুলিশ এখনো হত্যা রহস্যের মীমাংসা করতে পারেনি।
এর আগে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকেও রাজধানীর মিরপুরে তার বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডেও জঙ্গিবাদীদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়। একই বছর সাভারে জঙ্গি কায়দায় হামলায় নিহত হন ব্লগার আশরাফুল আলম।
হামলা হয়েছিল জঙ্গিদের ‘হিটলিস্টে’ থাকা ব্লগার আসিফ মহীউদ্দিনের ওপরও, তবে ২০১৩ সালে ওই হামলার সময় ভারী জামাকাপড় গায়ে থাকায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।