এবার নতুন জঙ্গি সংগঠন 'মুজাহিদ অব বাংলাদেশ'-এর সন্ধান

শাহরিয়ার শরীফ ও কামরান রেজা চৌধুরী
2015.12.03
BD-islamist এবার ‘মুজাহিদ অব বাংলাদেশ’ নামের নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পেয়েছে পুলিশ, যে সংগঠনের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।
বেনার নিউজ

বার ‘মুজাহিদ অব বাংলাদেশ’ নামের নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের খোঁজ পেয়েছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যে সংগঠনের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁদের প্রত্যেককে ছয় দিন করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। ডিবি বলেছে, গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ ও ১০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।

পুলিশ জানিয়েছে, নতুন এই সংগঠনটি জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আদলে সংগঠিত হচ্ছিল। রাজধানীর আরামবাগের একজন পীরকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের।

গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে; জহিরুল ইসলাম ওরফে আনসার ওরফে চূড়ান্ত লড়াই ওরফে জহির, খন্দকার রাজেশ সুবাহান ওরফে রাজু ওরফে কাঁচামরিচ ওরফে আদার ব্যাপারী, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে আবির ওরফে মৌমাছি ওরফে নিয়মের অনিয়ম ওরফে এক টুকরো মেঘ ওরফে সাদা পাতা আব্রাহাম আহম্মেদ আল তারেক, মোর্শেদুল ইসলাম ওরফে কিংমোর খান ও কাজী বাপ্পী আহমেদ ওরফে সাজ্জাদ ওরফে তারেক বিন জিয়া মোল্লা আক্তার মো. মনসুর।

ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহ এড়াতে ফেসবুক আইডিতে এসব বিচিত্র নাম ব্যবহার করত। এই আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানাতে গতকাল মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

“একজন পীরকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল মুজাহিদ অব বাংলাদেশের এই ছয় সদস্যের। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই বুধবার সন্ধ্যায় ডিবি ও পুলিশ সদর দপ্তরের আঁড়িপাতা শাখার (এলআইসি) যৌথ অভিযানে তাঁরা গ্রেপ্তার হয়,” জানান ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) ও ডিএমপি কমিশনারের মুখপাত্র মো. মনিরুল ইসলাম।


পীর ও বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শে বিশ্বাসীদের হত্যা

সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক একেএম মাহবুবুজ্জামান, যিনি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত, বেনার নিউজকে বলেন, “ভারত উপমহাদেশে ইসলামের সম্প্রসারণে পীরগণ ব্যাপক ভুমিকা পালন করেছে। তাঁরা স্বভাবে অহিংস প্রকৃতির ছিলেন, সেজন্য ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে তাঁরা যথেষ্ঠ সম্মানীয় ছিলেন”।

তিনি পীরদের প্রতি ইসলামী মৌলবাদীদের মারমুখি হবার কারণ হিসেবে বলেন তারা পীরদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের লোক মনে করে। তাদের মধ্যে একজন যেমন সিলেটে ইসলাম প্রচারের জন্য খ্যাত হযরত শাহজালাল।

অধ্যাপক মাহবুব অবশ্য কিছু ভূয়া পীরের কথাও বলেন যারা মানুষের কাছ থেকে ধর্মের নামে নানা অছিলায় অর্থ নিয়ে থাকে।

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইসলামি ফ্রন্টের নেতা নুরুল ইসলাম ফারুকীসহ কয়েকজন পীর ও বিভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শে বিশ্বাসী কয়েকজনকে হত্যার ঘটনা ঘটে।

এর মধ্যে গত ৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় নিজের বাড়িতে গলা কেটে হত্যা করা হয় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খানকে। খিজির খানের বাড়িতে একটি খানকা শরীফ ছিল এবং অনেকে তাকে পীর মানতেন।

এর আগে ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকার রাজাবাজারের বাসায় একইভাবে গলা কেটে হত্যা করা হয় ইসলামি ফ্রন্টের নেতা ফারুকীকে।

রাজধানীর গোপীবাগে কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ ছয়জনকে গলাকেটে হত্যা করা হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। গত কয়েক বছরে এক প্রকাশকসহ কয়েকজন ব্লগার-লেখকও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপরও হামলা হয়েছে।

খিজির খান ও গোপীবাগ হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার জেএমবি সদস্য তরিকুল ইসলাম মিঠু আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। ‘পীর’ খিজির খানের মতাদর্শকে ‘ধর্মীয় বিচ্যুতি’ ধরে নিয়ে জেএমবি সদস্যরা ‘ঈমানি দায়িত্ব’ মনে করে তাকে হত্যা করেছে বলে মিঠু পুলিশকে জানিয়েছিলেন।


আল কায়দাকে অনুসরণের চেষ্টা

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা বলেছে, তাঁরা আল-কায়েদার কর্মকাণ্ড পড়ে ওই সংগঠনটিকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছিল।তবে মনিরুল ইসলাম বলেন, এই জঙ্গিরা বিভিন্ন নামে ফেসবুক আইডি এবং পেজ খুলে সংগঠিত হচ্ছিল।

“তবে আল-কায়েদার সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগের কোনো প্রমাণ পায়নি ডিবি। আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের আল জাওয়াহিরির সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তারা জাওয়াহিরিকে অনুসরণ করেন,” জানান মনিরুল।

ডিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, মুজাহিদ অব বাংলাদেশের সংগঠিত হতে কয়েকটি ধাপ ব্যবহার করছে। এগুলোর মধ্যে আছে, সদস্য সংগ্রহে তারা তারা নামাজ কায়েমে দাওয়াতি কর্মকাণ্ডে যুক্ত করে।

একপর্যায়ে জিহাদে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলা হয় তাদের। শারীরিক অনুশীলনে যারা ভাল করে তাদের বাছাই করে প্রশিক্ষণের প্রস্তুত করা হয়। তাদের মূলত ছোড়া, চাকু চালানো ও বর্ষা নিক্ষেপে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বর্ষা নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের লক্ষ্যস্থির পারদর্শী গড়ে তোলা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তাদের দলে ২৫-৩০ জন সদস্য আছে। গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের আশপাশের জঙ্গল এবং চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিরা স্বীকার করে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, দুই বছর আগে শুরু হওয়া মুজাহিদ অব বাংলাদেশের  নির্দিষ্টভাবে সাংগঠনিক কোনো কাঠামো নেই। এদের মধ্যে কারও প্রযুক্তিগত জ্ঞান ভালো। সদস্যের মধ্যে কম শিক্ষিতও আছেন। এদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বলেন, মুজাহিদ অব বাংলাদেশের শীর্ষ নেতা মামুন আগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেছেন। কিন্তু তখন তিনি সংগঠনের নাম বলেননি। তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আরও তথ্য পাওয়া যাবে।

গ্রেপ্তার করা জঙ্গিদের পরবর্তী লক্ষ্য কি বা অস্ত্রের কোনো উৎস আছে কি না জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, এরা এখনো অস্ত্র কেনেননি। তাই তাদের অর্থের দরকার হয়নি। সব সদস্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। এদের কেউ কেউ উচ্চ বেতনে চাকরি করে। তারা জীবনযাত্রার টাকা রেখে বেতনের বাকি টাকা সংগঠনে দিয়ে দেয়।

গ্রেপ্তার করা ছয় জঙ্গি এর আগে অন্য কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল কি না জবাবে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বলেন, প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদে সে বিষয়ে কিছু স্বীকার করেনি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, কেউ কেউ অন্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বিষয়ে জানা যাবে।

বর্তমানে কোন কোন জঙ্গি সংগঠন সক্রিয় আছে জানতে চাওয়া হলে মনিরুল ইসলাম বেলন, জেএমবি ও হিযবুত তাহ্রীর নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। ইরাকের ঘটনার প্রেরণা নিয়ে তারা এখন সক্রিয় হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।