পঙ্গু সাংবাদিক প্রবীর ফেসবুকে জীবনের শঙ্কা প্রকাশ করায় জেলে গেলেন

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.08.17
BD-journalist সাংবাদিক প্রবীরকে পুলিশ ঢাকায় গ্রেপ্তার করে সোমবার ফরিদপুরে আদালতে নেয়। ১৭ আগষ্ট,২০১৫
বেনার নিউজ

এই প্রথম বাংলাদেশে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছে, যে মামলা দায়েরের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী ও সাংবাদিকেরা।

ফেসবুকে নিজের জীবন সম্পর্কে শঙ্কা প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দেওয়ার ‘অপরাধে’ সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।

প্রবীর তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১০ আগস্ট বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ‘আমার জীবন শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন’ শিরোনামে দেওয়া  স্ট্যাটাসে তিনি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন এমন তিনজনের নাম উল্লেখ করেন।

স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন- “আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবনের শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন: ১. এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি, ২. রাজাকার নুলা মুসা ওরফে মুসা বিন শমশের ৩. ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং এই তিনজনের অনুসারী-সহযোগীরা ।”

এই লেখার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগ তুলে মামলাটি করেন স্থানীয় আইনজীবী স্বপন পাল।

“ভয়াবহ দিকটি হলো এই আইনের অপব্যবহার। ক্ষমতাবানরা আইনের মাধ্যমে ক্ষমতার জঘন্যতম অপব্যবহার করছেন,” বেনারকে জানান আইনজীবী সারা হোসেন।

তিনি জানান, সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে রাতের বেলায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরা তো এত ক্ষতিকর নয় বা পালিয়ে থাকার মতো মানুষ নন যে তাদের এভাবে ধরা হবে।

সাংবাদিক প্রবীরের বাড়ি ফরিদপুরে। মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন ফরিদপুরের সংসদ সদস্য। মামলার বাদী স্বপন পাল ফরিদপুর পূজা উদ্যাপন কমিটির উপদেষ্টা।

মন্ত্রী মোশাররফ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই। প্রবীর গত বছরই প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হয়ে চীনে গিয়েছিলেন।

দৈনিক বাংলা ৭১, উত্তরাধিকার-৭১ নিউজ নামে অনলাইন পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর সিকদার। এর আগে তিনি জনকন্ঠ, সমকাল ও কালের কণ্ঠে কাজ করেছিলেন।


হামলায় বেঁচে গেলেও পা হারান

জনকণ্ঠে প্রবীর ২০০১ সালে দৈনিকটির ফরিদপুর প্রতিনিধি থাকাকালে সন্ত্রাসীর হামলায় গুরুতর আহত হন। এরপর থেকে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন তিনি।

দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সেই রাজাকার’ কলামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুসার বিতর্কিত ভূমিকার বিবরণ তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক প্রবীর, যার পরিবারের ১৪ জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

প্রবীর অভিযোগ করে আসছিলেন, ওই লেখার কারণে মুসার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা ওই হামলা চালায়।

প্রধানমন্ত্রীর ফুপাতো ভাই ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসার বাড়িও ফরিদপুরে।

সম্প্রতি একটি অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক লেখায় মুসা বিন শমসেরকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তুলনা করা হয়। এ নিয়ে নিজের ফেসবুকের পাতায় সমালোচনায় মুখর হন প্রবীর। এরপর তিনি জনকণ্ঠে প্রকাশিত মুসাকে নিয়ে তার পুরোনো লেখা তুলতে থাকেন।

রোববার গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নেওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও মুসাকে নিয়ে ‘জেনে নিন কে এই 'প্রিন্স ড. মুসা বিন শমশের'!’ লেখাটি ফেসবুকের পাতায় তোলেন প্রবীর, সেই সঙ্গে লেখেন-“যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালের সংখ্যা বাড়ছে! রেহাই নেই কারও !”


ঢাকা থেকে ফরিদপুর

গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় আটকের পর মধ্যরাতে প্রবীরকে ফরিদপুরে নেওয়া হয় । এর মধ্যেই তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায়।

ফরিদপুরের আইনজীবী স্বপন কুমার পালের করা ওই মামলায় ১০ দিনের জন্য হেফাজতে চেয়ে সন্ত্রাসীদের হামলায় পঙ্গু প্রবীরকে সোমবার বিকেলে আদালতে নেয় পুলিশ।

বিচার বিভাগীয় হাকিম মো. হামিদুল ইসলাম পুলিশের ওই আবেদনের শুনানির জন্য মঙ্গলবার দিন ঠিক করে প্রবীর সিকদারকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

ফরিদপুর কোতোয়ালি থানা সূত্রে জানা গেছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

ফেসবুকে লেখালেখিকে কেন্দ্র করে হুমকি পাওয়ার পর নিজের নিরাপত্তাহীনতার কথা তুলে ধরে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন একাত্তরে শহীদের সন্তান প্রবীর।

কিন্তু পুলিশ ওই জিডি নেয়নি জানিয়ে গত ১০ আগস্ট নিজের ফেসবুকে পাতায় একটি স্ট্যাটাসে নিজের জীবন নিয়ে ঝুঁকির কথা জানিয়ে তার জন্য মন্ত্রী মোশাররফকে দায়ী করেন প্রবীর।

“আমার বাবা একাত্তরে শহীদ হয়েছেন। প্রবীর দা এর আগে সন্ত্রাসী হামলায় পা হারিয়েছেন। এ রকম এক সাংবাদিকের প্রতি এ আচরণ অমানবিক ও দুঃখজনক,” টেলিফোনে বেনারকে জানান প্রবীর সিকদারের ভাই সুবীর সিকদার।


মামলার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন

তথ্য প্রযুক্তি আইন অনুযায়ী ভুক্তোভোগীকেই মামলা করতে হবে। কিন্তু তা না করে তৃতীয় কোনো পক্ষ মামলা করছে, যা আইনের পরিপন্থী বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

আইন অনুযায়ী এই মামলা করার ক্ষমতা রাখেন কেবল মন্ত্রী নিজে। কিন্তু তার পক্ষে মামলা করেছেন ফরিদপুরের একজন সরকারি আইনজীবী।

“মন্ত্রীর সুনাম ক্ষুণ্ন হলে বা তিনি হুমকির সম্মুখীন হলে তার নিজের মামলা করতে হবে। তৃতীয় একজন ব্যক্তির মামলা করা গ্রহণযোগ্য নয়,” বেনারকে জানান আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

প্রবীরকে গ্রেপ্তারের ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এজেডএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, “তথ্য প্রযুক্তি আইনে সুনির্দিষ্ট মামলার প্রেক্ষিতে প্রবীরকে ঢাকা পুলিশ গ্রেপ্তার করে।”

আইসিটি আইনে এখন পর্যন্ত একটি মামলার রায় হয়েছে। এতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে তিন বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এ ছাড়া এই আইনে একটি মামলায়  আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান কারাগারে আটক আছেন।


নিন্দা–প্রতিবাদের ঝড়

প্রবীরকে গ্রেপ্তারের পর ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় বইছে। গতকাল সোমবার বিকেলে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে বিক্ষোভ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।

এ সময় কর্মীরা ‘৫৭ ধারা বাতিল করো, প্রবীর সিকদারকে মুক্ত করো’ সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।

‘৫৭ ধারার কালাকানুন নিপাত যাক, বাক স্বাধীনতা মুক্তি পাক’ সহ বিভিন্ন বক্তব্য সম্বলিত প্ল্যাকার্ডও বহন করেন তারা । এর আগে দুপুরে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ‘বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ’।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।