বিচারপতিদের জন্য আচরণবিধি করবে সরকার

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.02.12
BD-justice প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা গত সোমবার তিনজন বিচারপতিকে শপথ পড়ান। উচ্চ আদালতের সব বিচারকের জন্য আচরণবিধি করতে যাচ্ছে সরকার।
বেনার নিউজ

দেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বাদানুবাদের রেশ না কাটতেই নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে উচ্চ আদালতে। এবার যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর পক্ষে সদ্য সাবেক বিচারপতি নজরুল ইসলাম ওকালতি করায় বিচারাঙ্গন ঘিরে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে সরকার বিচারকদের জন্য আচরণবিধি করার উদ্যোগ নিয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, “বিচারপতিরা সমাজের দৃষ্টান্ত। আমরা মনে করি তারা এমন কাজ করবেন যা অনুসরণীয়। সে জন্যই আমি মনে করি এখন সময় এসেছে রুলস করার।”

গত প্রায় এক মাস ধরে বিচারালয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা চলছে, যা নিয়ে সরকার বিব্রত। সরকার ছাড়াও বিচারালয়ে এবং বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে আলোচনা–সমালোচনা হচ্ছে।

‘বিচারালয়ে আমরা পাল্টাপাল্টি চাই না। আমরা চাই সবাই সহনশীল হবেন,” বেনারকে জানান বিশিষ্ট নাগরিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।


অবসর ছুটিতে গিয়েই যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে মামলা

সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আইন পেশায় নিয়োজিত হতে পারবেন কি-না, এ নিয়ে নতুন আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রথম  অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম জামায়াতের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ও অর্থদাতা হিসেবে পরিচিত মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের পক্ষে অংশ নিয়েছেন।

“এটি চরম নৈতিকতাবিরোধী,” সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম।

অন্যদিকে ওই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলছেন, “সংবিধান আমাকে 'প্র্যাকটিস' করার অধিকার দিয়েছে। আইন ও রীতি মেনেই আমি আইন পেশায় কাজ করছি।”

সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদের ২-এর (১)-এ বলা আছে, “কোনো ব্যক্তি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক পদে বহাল থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের পর তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি বা কার্য করিতে পারিবেন।”

হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী গত ১৩ ডিসেম্বর অবসরে যান। তিনি অবসর-পরবর্তী ছুটিতে (পিআরএল) রয়েছেন। অবসরে গেলেও তিনি সরকারি বাড়িতে থাকছেন, সরকারের গাড়ি ব্যবহার করছেন। এ অবস্থায় তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কোনো মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে আইনি লড়াই চালাতে পারেন না বলে আইনজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।

“হাইকোর্টের বিচারকের প্র্যাকটিস করতে সংবিধান অনুযায়ী বাধা নেই। তবে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়া অবস্থায় তা অবশ্যই নৈতিকতাবিরোধী,” বেনারকে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ।

তাঁর মতে, এটা তার জন্য অনুচিত, অনৈতিক ও পেশাগত অসদাচরণ।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর করা আপিল আবেদনের ওপর শুনানিতে সাবেক বিচারপতি নজরুল অংশ নেন।

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন কাসেম আলীকে মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতাকারী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তার প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় চট্টগ্রামে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়।


আচরণবিধি তৈরির উদ্যোগ

বিচারপতিদের জন্য আচরণবিধি থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।

“বিচারপতিরা সম্মানীয়, তাদের আচার-আচরণ অন্যের জন্য অনুকরণীয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এখন তাদের জন্য আচরণবিধির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে,” সাংবাদিকদের জানান আইনমন্ত্রী।

সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বাদানুবাদ, মীর কাসেম আলীর পক্ষে সাবেক বিচারপতি ওকালতি ইত্যাদি বিষয়ে ইঙ্গিত করে মন্ত্রী বিচারকদের জন্য আচরণবিধির কথা বলেন।

মন্ত্রী বলেন, বিচারপতিরা তাদের বিবেক দ্বারা চালিত হবেন। যেহেতু বিজ্ঞ বিচারপতি, সম্মানিত বিচারপতি—তাই বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই তারা কী আচরণ করবেন। এ জন্যই এত দিন কোনো রুলস ছিল না।


আরেক বিচারপতির বক্তব্যে সরকার বিব্রত

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্যে সরকার বিব্রত হলেও করণীয় খুঁজে পাচ্ছে না। ঘটনার শুরুটা হয়েছিল প্রধান বিচারপতির একটি মন্তব্যের মধ্য দিয়ে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, অবসরে যাওয়ার পর বিচারকদের রায় লেখা অসাংবিধানিক। গত ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এক বাণীতে তিনি এ কথা বলেন।

বিরোধী দল বিএনপি প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে ঘিরে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। দলটি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় অবৈধ এবং অসাংবিধানিক বলে মন্তব্য করে।

উল্লেখ্য, অবসরপ্রাপ্ত আরেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখেন। এই রায়ের মাধ্যমে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটে।

ওই রায় অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট নির্বাচন বর্জন করে।

প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের জের ধরে বিএনপি ওই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে, আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আগে থেকেই তিক্ত সম্পর্ক থাকা শামসুদ্দিন চৌধুরী সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন।

অবসরে যাওয়ার পরপরই প্রধান বিচারপতির অভিশংসন চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন। এখনো তিনি প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ চান। তাঁর অভিযোগ, প্রধান বিচারপতি তাঁর পেনশন আটকে রেখেছেন।

“বিচারালয়ে যা কিছু হচ্ছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত ও অত্যন্ত দুঃখজনক। এসবের অবসান হওয়া উচিত। কে, কতটুকু বলতে পারবেন—এটা কারও অজানা নয়,” সাংবাদিকদের জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

গত সোমবার শামসুদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, প্রধান বিচারপতি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্য’ নিয়ে কাজ করছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা রায় লিখতে পারবে না, এ কথা বহু আগে খালেদা জিয়া বলেছিলেন। উনি (প্রধান বিচারপতি) খালেদা জিয়ার মুখপাত্র হয়ে বিএনপির এজেন্ডা চরিতার্থ করার জন্য এটা বলেছেন।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা খালেদা জিয়ার মুখপাত্র হয়ে বিএনপির এজেন্ডা চরিতার্থ করছেন বলে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার জবাবে দলটি বলেছে, এই বক্তব্য কোনো বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কথা নয়।

শামসুদ্দিন চৌধুরীর প্রতি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “যদি প্রধান বিচারপতি বেগম খালেদা জিয়ার মুখপাত্র হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি কার মুখপাত্র ছিলেন?” তিনি দাবি করেন, আদালতের মতো পবিত্র অঙ্গনকে কলুষিত করেছিলেন এই মানিক।

‘বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর কর্মকাণ্ড বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে’ বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি যা করছেন তা ঠিক নয়। এগুলো বন্ধ করা উচিত।”

আইন মন্ত্রণালয় ছাড়াও প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এমনকি বিরোধী দল বিএনপিও শামসুদ্দিন চৌধুরীর মতের বিপক্ষে অবস্থা নিয়েছেন। কিন্তু  অবসরে যাওয়া ওই বিচারপতিকে কেউ থামাতে পারছেন না।

তবে গত সোমবার শামসুদ্দিন চৌধুরী তাঁর হাতে লেখা প্রায় ৬৫টি রায় ও আদেশসহ সংশ্লিষ্ট মামলার নথি জমা দিয়েছেন, যা ইতিবাচক হিসেবে মনে করছেন কেউ কেউ। অবসরে যাওয়ার আগে তিনি এসব মামলার রায় ঘোষণা করলেও তা লেখেননি।

“অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে যেহেতু বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেহেতু উচ্চ আদালতই একটি বিধি করে দিতে পারে। ওই বিধিতে বলে দেওয়া হবে রায় ঘোষণার কত দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রকাশ করা যাবে,” বেনারকে জানান সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।