হিন্দু পুরোহিতকে হত্যা, আবারও আইএসের নাম, ৩ গ্রেপ্তার

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.02.22
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
BD-killing পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় শ্রীশ্রীসন্ত গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
বেনার নিউজ

বেশ কিছুদিন বিরতি দিয়ে এবার দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলায় শ্রীশ্রীসন্ত গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুষ্কৃতকারীদের গুলিতে মঠের একজন সাধু আহত হয়েছেন।

আগের নৃশংস ঘটনাগুলোর মতোই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) পঞ্চগড়ের অধ্যক্ষকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের প্রধান রিটা কাৎজ এক টুইটার বার্তায় এ কথা জানান।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, একাধিক খ্রিষ্টান পাদরিকে হত্যার চেষ্টা এবং আহমদিয়া ও শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে বোমা হামলাসহ নয়টি ঘটনায় আইএস দায় স্বীকার করেছিল।

তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এসব দাবি নাকচ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও একাধিকবার বলেছেন, এ দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই।

সর্বশেষ পঞ্চগড়ের ঘটনায় আইএসের দায় স্বীকারকে নাকচ করে দিয়ে জেলার পুলিশ সুপার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।

পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দুর্বৃত্তদের ফেলে যাওয়া একটি রক্তমাখা জ্যাকেট, রক্তমাখা চাপাতি, পিস্তলের গুলি ও একটি তাজা ককটেল উদ্ধার করেছে। কালো টেপ দিয়ে মোড়ানো ককটেলের গায়ে মার্কার কলম দিয়ে ইংরেজিতে ‘আইএস’ লেখা রয়েছে।

গত রোববার সকাল সাতটার দিকে দেবীগঞ্জ-বোদা সড়কের পাশে সোনাপাতা এলাকায় যখন হামলার ঘটনাটি ঘটে, তখন শ্রীশ্রীসন্ত গৌড়ীয় মঠের ছোট মন্দিরে প্রতিদিনের মতো নিত্য পূজার প্রস্তুতি চলছিল। মঠের পাশেই একটি টিনের ঘরে থাকতেন পঞ্চাশ বছর বয়স্ক যজ্ঞেশ্বর রায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, হামলাকারী ছিল তিনজন। একজন হেলমেট পরে মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। অন্য দুজনের মধ্যে একজন পিস্তল, অন্যজন চাপাতি নিয়ে ভেতরে ঢোকে।

“এ ঘটনার পর আমরা আতঙ্কিত। যদিও গতকাল সোমবার সকালে মঙ্গলা আরতি এবং প্রার্থনা হয়েছে,” স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান মঠের পুজারী রাধা মাধব দাস।


সরকার দায় এড়াতে পারে না: বিএনপি

বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, যজ্ঞেশ্বর রায়কে হত্যার দায় সরকার কোনোভাবে এড়াতে পারে না। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল সোমবার যজ্ঞেশ্বর হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে এক বিবৃতিতে এ কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল বলেন, কোনো ধর্মগুরুকে হত্যার মতো ঘৃণ্য অপকর্মের নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। যারা এই জঘন্য নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে তারা সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবতার শত্রু। দেশকে গহিন অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়াই এদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, ইতিপূর্বে বিদেশি নাগরিক, ব্লগার, প্রকাশক হত্যাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর হামলার কোনো ঘটনার সুরাহা করতে পারেনি সরকার। অথচ জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ বারবার দায় স্বীকারকারীদের বার্তার কথা উল্লেখ করলেও সরকার এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সরকারের এ ভূমিকায় জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে এই রক্তাক্ত দুষ্কর্মের নেপথ্য শক্তি কারা?


মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ  

যজ্ঞেশ্বর রায়কে গলা কেটে হত্যার প্রতিবাদে গতকাল সোমবার সকালে দেবীগঞ্জ উপজেলাবাসীর ব্যানারে উপজেলা সদরের বিজয় চত্বরে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কর্মসূচিতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, জাগো হিন্দু পরিষদ, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, সিপিবিসহ বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের বিভিন্ন সাধু সন্ন্যাসী, স্থানীয় স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মী ছাড়াও কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেয়।

সমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যই জামায়াত-শিবির এবং মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা জড়িতদের  ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের দাবি জানান।


দুই মামলা, গ্রেপ্তার তিন

দেবীগঞ্জ থানায় গত রোববার রাতে দায়ের করা পৃথক দুটি মামলা তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হত্যা মামলার বাদী যজ্ঞেশ্বরের বড় ভাই রবীন্দ্র রায় এবং অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলার বাদী দেবীগঞ্জ উপপরিদর্শক মো. মজিবর রহমান।

গত রোববার রাতে গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে দেবীগঞ্জ উপজেলার দন্ডপাল ইউনিয়নের কালীগঞ্জ গ্রামের খলিলুর রহমান (৪৫), একই উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়নের প্রধানপাড়া গ্রামের বাবুল হোসেন (৩৫) এবং উপজেলা সদরের জাহাঙ্গীর আলম (৩০)। এদের মধ্যে প্রথম দুজন নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন জেএমবির সঙ্গে জড়িত। জাহাঙ্গীর শিবিরের নেতা এবং সন্ত্রাস নাশকতা মামলার আসামি। খলিলুর রহমান ২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলা মামলার আসামি হলেও পরে তিনি ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পান।

ঘটনার পর পরই জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দীন মোহাম্মদকে প্রধান করে আট সদস্যের ঘটনার তদারকি টিম গঠন করা হয়েছে।

“কোনো সন্ত্রাসী বা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। আশা করছি জড়িতদের গ্রেপ্তার করে ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে,” বেনারকে জানান দীন মোহাম্মদ।


যজ্ঞেশ্বরের শত্রু ছিল না

নিহত যজ্ঞেশ্বর রায়ের বাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলার সোনাহারে। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে গত সোমবার বিকেলে তাঁর লাশ মঠ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে মঠের পাশে করতোয়া নদীর তীরে শ্মশানে তাঁর লাশ দাহ করা হয়।

“আমার ভাই স্বেচ্ছায় গৃহ ও সংসার ত্যাগ করে এমন জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এখানে ধর্মসভা, ধর্ম নিয়ে আলোচনা আর পূজা-অর্চনা নিয়ে থাকতেন। তাঁর কোনো শত্রু ছিল না,” জানান যজ্ঞেশ্বরের ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথ রায়।


গুলিবিদ্ধ ভক্ত গোপাল ঢাকায়

এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ সাধু গোপাল চন্দ্র রায়কে (৩৫) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সোমবার বিকাল ৪টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে (এনআইসিভিডি) পাঠানো হয়।

“আমি মঠের রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। আর কীর্তন গাইছিলাম। এমন সময় চিৎকারের শব্দ কানে আসে। বুঝতে পারি, এটা গুরুজির (যজ্ঞেশ্বর) গলার আওয়াজ। তখন রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দুজন লোককে দেখতে পাই। তাদের পরনে প্যান্ট ও টুপিওয়ালা জ্যাকেট (হুডি) ছিল,” ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বেনারকে জানান গোপাল চন্দ্র রায়।

গোপাল আরও বলেন, “আমাকে দেখামাত্র তারা কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি ছোড়ে। আমার বাঁ হাতে দুটি গুলি লাগে। তখন আমি দেয়াল টপকে পার হয়ে চিৎকার করতে থাকি।”

গোপাল রায়ের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ও হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. সৈয়দ আবু তালেব সাংবাদিকদের বলেন, গোপালের গুলিবিদ্ধ বাম হাতে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কখনো রক্ত চলাচল করছে, আবার কখনো রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

চার সদস্যের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গোপালের গুলিবিদ্ধ হাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে ।

যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিন্দা
হিন্দু পুরোহিত যোগেশ্বর রায় হত্যার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সেই সঙ্গে নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে হত্যায় জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তিরও দাবি জানিয়েছে ইইউ।

ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান।

পিয়েরে মায়াদু মনে করেন, কোন একটি ধর্মের ওপর আঘাত মানেই সব ধর্মের ওপর আঘাত। তিনি নিবিড় তদন্তের মাধ্যমে ওই অপরাধে জড়িতদের বিচারের কাঠগড়ায় আনতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক নৃশংস হামলার উদ্বেগ জানিয়ে তাঁর টুইট অ্যাকাউন্টে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

অ্যালিসন ব্লেইক গতকাল বিকেলে তাঁর টুইট অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, যোগেশ্বর রায় ও গোপাল চন্দ্র রায়ের ওপর নৃশংস হামলা আমাকে আতঙ্কগ্রস্ত করেছে। লোকজনকে তাদের ধর্ম কিংবা বিশ্বাসের কারণে হামলার যুক্তি দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ নেই।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।