হিন্দু ধর্মগুরু হত্যায় আরো তিনজনকে আটকের দাবি পুলিশের
2016.02.26
বাংলাদেশের পঞ্চগড়ে এক হিন্দু ধর্মগুরুকে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যারা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য এবং এদের একজন ওই হত্যাকাণ্ডের হোতা বলে দাবি পুলিশের।
আটক করা হলেও তাদের পরিচয় প্রকাশ করছে না পুলিশ। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে পূর্বের কিছু হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে বিভিন্ন সময় ‘সন্দেহভাজন’ আটক এবং পরে সম্পৃক্ততা প্রমাণ করতে না পারার ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রেক্ষিতে সমালোচনার মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট সম্পৃক্ততা ছাড়া শুধুমাত্র ঘটনা ধামা চাপা দেওয়ার কৌশল হিসেবে যদি আটক করা হয়, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
প্রধান হোতাসহ আটক তিন: পুলিশ
শুক্রবার পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির এক সংবাদ সম্মেলনে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য জানান। এসময় উদ্ধার করা অস্ত্র সংবাদ সম্মেলনে প্রদর্শন করা হলেও গ্রেপ্তারদের নাম প্রকাশ করেননি তিনি।
তিনি জানান, এর আগে ওই ঘটনায় আটক ও রিমান্ডে থাকা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাতে পঞ্চগড় ও নীলফামারী জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং হত্যাকান্ডে ব্যবহার করা ছুরিসহ অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এরা জেএমবির স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতা।
ডিআইজি হুমায়ুন বলেন, মঠ প্রধান হত্যার ঘটনায় সরাসরি পাঁচ জন জড়িত। যাদের মধ্যে তিন জনই এ বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার হলো। এদের মধ্যে একজন হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা। পুরোহিতকে জবাইকারী মূল অপরাধী, অপারেশনের আগে ও পরে যার বাসায় অস্ত্র রাখা হয়েছিল তাকে এবং হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে ঘটনাস্থলসহ আশপাশে নজরদারী করা ব্যক্তি এই তালিকায় আছে।
পাঁচজনের বাকি দুই জনকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। বলেও জানান তিনি।
শুধু এই পুরাহিতই নন, সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরাঞ্চলে যে কয়েকটি হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে সবগুলোর সঙ্গেই জেএমবির সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে দাবি করেন এই বিভাগীয় পুলিশ কর্তা।
এদিকে পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার তিনজন হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন বলে দাবি পুলিশের। এ বিষয়ে ডিআইজি হুমায়ুন কবির “আটক হওয়া ব্যক্তিরা পুলিশের কাছে পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছে।”
‘আইএস জঙ্গি নয়, জেএমবি সদস্যরা জড়িত’
আগের নৃশংস ঘটনাগুলোর মতোই মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) পঞ্চগড়ের অধ্যক্ষকে হত্যার দায় স্বীকার করে বলে দাবি করে জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক ততপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। তবে পুলিশ শুরু থেকেই আইএস’র বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিল।
আসামি আটকের পর ডিআইজি হুমায়ূন বলেন, “আইএস জঙ্গি নয়, জেএমবি সদস্যরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মূলত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও দেশকে অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।”
পরিচয় প্রকাশ করলো পরিবার
পুলিশ পরিচয় প্রকাশ না করলেও গ্রেপ্তার হওয়া তিন জনের মধ্যে দুজনের স্বজনরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করেছে। এই দুজনের বাড়ি একই উপজেলায় বলে দাবি তাদের। এরা হলেন দেবীগঞ্জের সুন্দরদীঘি ইউনিয়নের ভ্যানচালক হারেজ আলী (৩২) এবং দণ্ডপাল ইউনিয়নের রমজান আলী (২২)।
হারেজের স্ত্রী জমিরন জানান, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে পুলিশের ডাকে ঘুম থেকে জেগে ঘর থেকে বের হলে তত্ক্ষণাৎ হারেজকে আটক করা হয়। এরপরেই পুলিশ গোয়ালঘরে প্রবেশ করে।’
এই গোয়াল ঘর থেকেই অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে বলে দাবি করে আসছে পুলিশ।
জমিরন বলেন, হত্যার দিন রাতেও নীলফামারী র্যাবের একটি দল হারেজকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে পরদিন ছেড়ে দেয় জানিয়ে জমিরণ বলেন, “আমার স্বামী ওই ঘটনায় জড়িত নন বলে জানিয়েছেন।”
রমজানের বড় ভাই মিজানুর রহমান জানান, নীলফামারীর একটি কলেজে বিএ‘র ছাত্র রমজান এক সময় ইসলামী ছাত্রশিবির করলেও পরিবারের আপত্তিতে এখন আর কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়।
গত ২১ ফেব্রুয়রি দেবীগঞ্জের সোনাপোতা গ্রামের সন্তগৌরীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তাদের গুলি ও বোমার বিস্ফোরণে একজন সাধুসহ দুইজন আহত হন।
ওই ঘটনায় নিহতের বড় ভাই হত্যা মামলা করলে খলিলুর রহমান ও বাবুল হোসেন নামে দুই জেএমবি সদস্য এবং জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক শিবির নেতা ও নাজমুস সাকিব নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আটক হয়। তবে পরে ওই ঘটনার সঙ্গে নাজমুস সাকিবের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে জানায় পুলিশ।
‘ধামা চাপা দেওয়ার কৌশল হিসেবে সাধারণ মানুষকে হয়রানি অযৌক্তিক’
এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকৃত অপরাধীদের ধরার পরিবর্তে যাতে কোন সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়ে পুলিশকে আরো সতর্ক থাকতে হবে। আর প্রকৃতভাবে সম্পৃক্ত কেউ আটক হলেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত আর কারা আছে সে বিষয়টি ষ্পষ্ট হবে।
এ বিষয়ে গণজ্গরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার বেনারকে বলেন, “সন্দেভাজন আটক করা এবং তার কয়েকদিন পরে তাদের সম্পৃক্ততা খুঁজে না পাওয়া -এই ঘটনা বারবার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। একটা মানুষের সুনির্দিষ্ট সম্পৃক্ততা না পেলে তাকে আটক করে জনগণকে ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলার কোন মানে হয় না। একই সঙ্গে ওইসব ব্যক্তিকেও অকারণে হয়রাণির শিকার হতে হয়”।
আইএস না জেএমবি সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, “যারা হত্যা করছে, তারা জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এখন তারা আইএস না জেএমবি এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। যখন সুনির্দষ্ট অভিযোগে অপরাধীদের আটক করতে পারছে না, তখন এটা আইএস না জেএমবি সেই ধোঁয়াশা কাটানো সম্ভব না। সুতরাং অভিযুক্তদের খুঁজে বের করতে পারলেই এদের সঙ্গে কাদের সম্পৃক্ততা আছে সেটিও বের করা সম্ভব।”