ধর্মান্তরিত দুই চিকিৎসক হত্যার তদন্তে অগ্রগতি নেই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.03.16
BD-killing গত সোমবার কালীগঞ্জ উপজেলায় শিয়া মতাদর্শের হোমিও চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাককে (৫০) হত্যার পর মঙ্গলবার দায় স্বীকার করে আইএস।
অনলাইন

দেশের  দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা ঝিনাইদহে দুই হোমিও চিকিৎসককে প্রায় দুই মাসের ব্যবধানে হত্যার দায়  স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এদের একজন  শিয়া মতাদর্শে,  অপরজন  খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।

গত সোমবার কালীগঞ্জ উপজেলায় শিয়া মতাদর্শের হোমিও চিকিৎসক আবদুর রাজ্জাককে (৫০) হত্যার পর মঙ্গলবার দায় স্বীকার করে আইএস।

এর আগে গত ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বেলেখাল বাজারে আরেক হোমিও চিকিৎসক ছামির আলীকে (৮২) নিজ চিকিৎসালয়ে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনায়ও আইএস দায় স্বীকার করে জানায়,  খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।

যদিও সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে  স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, আইএস এর এসব দাবি সঠিক নয়।

এ পর্যন্ত দুই বিদেশিসহ প্রায় একডজন হত্যার দায় আই এস স্বীকার  করলেও সরকার জঙ্গীদের ওই দাবি  মানতে নারাজ। আবার  ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়নি।


গ্রেপ্তার হয়নি কেউ

সবশেষ এই দুটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত  সন্দেহে কাউকে আটক করেনি  পুলিশ। এখন পর্যন্ত পুলিশ কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি।

স্থানীয়  একাধিক সূত্র জানায়, মাস দুয়েক আগে ছামির আলীকে হত্যার পর এলাকার জামায়াত  ও ইসলামী ছাত্র শিবিরের দুই  নেতাকে কে বা কারা অপহরণ করে। তিন থেকে চার সপ্তাহের  মধ্যে তাদের লাশ পাওয়া যায় পাশের যশোর জেলার চৌগাছা ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলায়। এরা হলেন জামায়াত  নেতা আবু হোরাইয়া ও শিবির নেতা জসীম উদ্দিন (২৪)।

গত ৪ মাচ ঝিনাইদহে জসীম উদ্দিনের  লাশ উদ্ধার করা হয়। জামায়াতের  নেতা আবু হোরাইয়ার লাশ উদ্ধারের পাঁচ দিনের মাথায় এ ঘটনা ঘটে। অপহৃত হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন দুজন।

জসীম গান্না ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। তিনি সদর উপজেলার গান্না ইউনিয়নের কালুহাটি গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে। পড়তেন ঝিনাইদহ আলীয়া মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষে।

নিহত ব্যক্তির ভাই সাইফুর রহমান স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, জসীম গত ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেট থেকে বাসযোগে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে গোয়ালন্দ ঘাট এলাকায় কয়েক ব্যক্তি নিজেদের পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য পরিচয় দিয়ে তাঁকে নামিয়ে নেয়। এরপর গতকাল সকালে ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার হিঙ্গেরপাড়া গ্রামের মাঠে তাঁর লাশ পাওয়া যায়।

এ প্রসঙ্গে  হরিণাকুণ্ডু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহাতাব উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, কৃষকেরা মাঠে গিয়ে গুলিবিদ্ধ লাশ দেখে পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ সকাল ১০টার দিকে লাশ উদ্ধার করে থানায় আনে। এরপর থানায় নিহত ব্যক্তির ভাই সাইফুর লাশটি শনাক্ত করেন।

এর আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি গান্না ইউনিয়ন জামায়াতের কর্মী ও মাদ্রাসাশিক্ষক আবু হুরাইয়ার (৩২) লাশ যশোরের চৌগাছা উপজেলায় পাওয়া যায়। তিনি একই ইউনিয়নের অশ্বস্থলী গ্রামের মৃত নাসির উদ্দিনের ছেলে।

নিহত ব্যক্তির ভাই আবদুল মালেক বলেন, আবু হুরাইয়াকে গত ২৪ জানুয়ারি কর্মস্থল কুটি-দুর্গাপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে ডিবি পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায় সাদাপোশাকের কয়েকজন। এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তাঁরা। এরপর ২৯ ফেব্রুয়ারি তাঁর লাশ পাওয়া যায়।

স্থানীয়  একাধিক সাংবাদিক বেনারকে জানান, নিহত ওই দুজন স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে  ক্রসফায়ারে মারা গেছে বলে গুঞ্জন থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা স্বীকার করেনি। কারা তাদের হত্যা করেছে তা নিয়ে পুলিশের বক্তব্য নেই।

এদিকে রাজ্জাক হত্যার ঘটনায়ও অগ্রগতি নেই।

“রাজ্জাক হত্যার কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে জোর চেষ্টা চলছে। আশা করছি, দ্রুত হত্যাকারীরা শনাক্ত হবে,“ বেনারকে জানান কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন ।


আইএসের দাবি

জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের প্রধান রিটা কাৎজ গত মঙ্গলবার এক টুইটার বার্তায় রাজ্জাক হত্যায় আইএসের জড়িত থাকার কথা  জানান।

“আইএসের দাবি নিয়ে আমরা ভাবছি না। তেমন কোনো আলামতও পাওয়া যায়নি,“ জানান  কালীগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রাজ্জাকের হোমিও দোকানে স্থানীয় কয়েকজন পুলিশের যাতায়াত ছিল। কিছুদিন আগে দুজন মাদকসেবীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ওদের ধারণা,  রাজ্জাকই তাদের ধরিয়ে দিয়েছে। ওই মাদকাসক্তরা সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছে। তাই ওই মাদকাসক্তদের  সন্দেহ করা হচ্ছে।“

এর আগে গত ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বেলেখাল বাজারে আরেক হোমিও চিকিৎসক ছামির আলীকে (৮২) নিজ চিকিৎসালয়ে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

ওই ঘটনায়ও আইএস দায় স্বীকার করে। পরদিন আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সও সাইট এর খবর প্রচার করে।

এতে বলা হয়, আইএস দাবি করেছে যে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ায় ছামির আলীমকে হত্যা করা হয়েছে।


বিচার চায় রাজ্জাকের স্বজনেরা

আবদুর রাজ্জাক সোমবার রাত ১০টার দিকে কালীগঞ্জের নিমতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তাঁর হোমিও চিকিৎসালয় থেকে বাসায় ফেরার পথে খুন হন।

নিহতের  স্বজনেরা জানান, আবদুর রাজ্জাক শিয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার খড়াশুনি গ্রামে। তিনি প্রায় এক যুগ আগে কালীগঞ্জের নিমতলা বাসস্ট্যান্ডের কাছে চাপালী এলাকায় বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন।

সেখানে  তিনি শিয়া মতাদর্শের প্রচার শুরু করেন। তাঁর কিছু অনুসারীও রয়েছেন।

“আমার ভাই একটি মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও কখনো অন্যায় করেননি। তাঁকে কারা হত্যা করেছে, জানি না। তবে ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই,“ বেনারকে জানান  রাজ্জাকের ভাই সাবজাল খান।  

এ ঘটনায় রাজ্জাকের আরেক ভাই শওকত আলী বাদী হয়ে কালীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেছেন।






মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।