মুঘল স্থাপত্য লালবাগ কেল্লার সৌন্দর্যহানির আশঙ্কা
2015.06.29

ঢাকায় মুঘল স্থাপত্যের একমাত্র অক্ষত নিদর্শন লালবাগ কেল্লার সীমানা প্রাচীরের একটি অংশের দেওয়াল ভেঙে গাড়ি রাখার জায়গা তৈরি করছে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর। তবে এর মাধ্যমে এই প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের সৌন্দর্য নষ্ট করা হচ্ছে- পরিবেশবাদীদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের নির্দেশে তা বন্ধ রাখা হয়েছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, লালবাগ কেল্লার প্রাচীর ভাঙার ঘটনা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রক্ষায় সরকারের গাফিলতির আবারও প্রমাণ করল। তবে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের দাবি যে অংশটি ভাঙা হয়েছে সেটি প্রত্নতত্ব নিদর্শন নয়। একারণে তা ভাঙায় লালবাগ কেল্লার সৌন্দর্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।
এর আগেও কয়েকবার ওই দেওয়াল ভাঙা ও পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা এক রিটের শুনানি শেষে রোববার এই কেল্লার সীমানা প্রাচীর ভেঙে গাড়ি রাখার জায়গা তৈরির কাজ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ করার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
আদালতের নির্দেশে সেখানকার নির্মান কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে বেনারকে জানান প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন।
তিনি বলেন, “আদালতের নির্দেশনা মেনেই লালবাগ কেল্লার বিষয়ে পরবর্তি যে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
চারদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা লালবাগ কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিতদের কার্যালয়ের এক পাশে সীমানা প্রাচীরের ১০ ফুটের মতো জায়গা নিয়ে দেওয়াল ভাঙা হয়েছে। মূলত সেখানে ভিআইপিদের গাড়ি রাখার জায়গা তৈরির কাজ চলছিল। শুরু থেকেই এ উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের বেনারকে বলেন, “ঐতিহ্যবাহী মুঘল আমলের এই কীর্তির প্রাচীর ভেঙ্গে কেল্লার ভিতরে পার্কিং অবকাঠামো নির্মাণ করা জাতির জন্য লজ্জাজনক। যা বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৪, পুরাকীর্তি আইন, ১৯৬৮, ঢাকা ইমারত নিমার্ণ বিধিমালা, ২০০৮ এবং হাইকোর্টের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”
তিনি বলেন, “সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সুবিধার জন্য লালবাগ কেল্লায় প্রাইভেট গাড়ির পাকিং নির্মান করা হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় যানজট, দূষণ এবং দূঘর্টনা আরো বৃদ্ধি পাবে।”
হেরিটেজ নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তৈমুর ইসলাম বেনারকে বলেন, “লালবাগ কেল্লা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। কয়েকবছর আগে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ করার জন্য নমিনেশনও পায় কেল্লাটি। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটির কারণে সেটি চূড়ান্ত হয়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উচিত ছিল সে ত্রুটি দূর করার চেষ্টা করা। সেটি না করে তারা বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি পার্কিং স্পেস তৈরি করছে।”
তিনি বলেন, যে স্থানটিতে পার্কিং স্পেস তৈরি করা হচ্ছে এটি একটি গার্ডেন স্পেস, এখানে বাগান করলে কেল্লার নান্দনিকতা বৃদ্ধি পাবে। যা মূলত লালবাগ কেল্লার বৈশিষ্ট্য।”
এদিকে লালবাগ কেল্লা ও জাদুঘরের কাস্টডিয়ান সুলতানা জাকিয়া বেদৌরা বেনারকে বলেন, “যে সীমানা প্রচীরটি ভাঙা হয়েছে তা পুরাকীর্তির অংশ নয়। এটা তৈরি হয় স্বাধীনতার পরে। আন্দোলনকারীলা না জেনেই আন্দোলনে নেমেছেন। তাছাড়া পার্কিং স্পেসটি কেল্লার সৌন্দর্য নষ্ট করলে তা সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল আমাদের।”
পূর্ণাঙ্গ হয়নি হেরিটেজ তালিকা
দেড় বছর আগে পূর্ণাঙ্গ হেরিটেজ তালিকা তৈরির ব্যাপারে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিলেও সে বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং পুরোনো ঢাকায় একের পর এক প্রত্নতাত্বিক স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে।
এমনকি ২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে যে ৯৩ টি ভবন ও চারটি এলাকাকে হেরিটেজ হিসাবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিলো সেগুলোর স্থাপনাও বাদ যাচ্ছে না ধ্বংসের হাত থেকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণত ১০০ বছর বা তার বেশি পুরনো স্থাপনাকে হেরিটেজের তালিকায় রাখা হয়। ওই তালিকাভুক্ত স্থাপনা ভেঙে নতুন স্থাপনা গড়তে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে হেরিটেজ তালিকায় থাকা এসব স্থাপনা ভাঙতে হলে রাজউকের বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন তদারকি নেই।
কয়েকমাস আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হেরিটেজ তালিকার জন্য একটি সাবকমিটি করা হয়েছে- বলেন তৈমুর ইসলাম, যিনি নিজেও ওই কমিটির সদস্য।
তিনি জানান, “এখন পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে ১৫টির মত স্থাপত্য এ তালিকায় আনা হয়েছে। তবে তা চূড়ান্ত নয়।”
২০০৯ সালে সরকারি গেজেটে হেরিটেজ হিসাবে লালবাগ তালিকাভুক্ত।
লালবাগ কেল্লা ছাড়াও ঢাকায় আরও দুটি মোঘল স্থাপত্য আছে। ছোট কাটরা ও বড় কাটরা- যা হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এগুলোর মধ্যে লালবাগ কেল্লাই অক্ষত রয়েছে। অবৈধ দখলের কারণে প্রায় ধ্বংসের মুখে রয়েছে বাকী দুটি।
তবে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন বলেন, “সব ধরনের পুরাতন স্থাপত্য রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। সেকথা বিবেচনায় নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”