পুলিশের গুলিতে মাদ্রাসার ছাত্র নিহত, রেলে আগুন, দিনভর তান্ডব

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.01.12
BD-madrasa ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসার ছাত্ররা রেল স্টেশনে আগুন দেয়।
বেনার নিউজ

ক্ষুদ্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বাহ্মণবাড়িয়া শহর। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে সারাদেশে বুধবার হরতাল ডাকে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। পরে প্রত্যাহার করে নেয়।

কওমী মাদ্রাসা প্রধান এ এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শেষমেষ শহরে র‍্যাব (র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) ও বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মোতায়েন করা হয়। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও গঠন করা হয়েছে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি।

সোমবার শুরু হওয়া ঘটনায় মঙ্গলবারও দিনভর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুলিশ, ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও মাদ্রাসা ছাত্রদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ। সহপাঠীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালানো, সড়ক ও রেলপথ অবরোধ, পুলিশের গাড়িতে আগুন, রেললাইন তুলে ফেলাসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও তান্ডব চালায় মাদ্রাসা ছাত্ররা।

সারাদেশে ডাকা বুধবারের হরতাল  'তৌহিদ-ই-জনতা'র পক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর সাথে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে এই হরতাল প্রত্যাহার করা হয় বলে জানা গেছে।


তুচ্ছ ঘটনায় শুরু, ছাত্রের মৃত্যু

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার শুরু একটি মোবাইল কেনাকে কেন্দ্র করে। সোমবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জেলা পরিষদ মার্কেটের একটি দোকানে একজন মাদ্রাসা ছাত্র মোবাইল কিনতে গিয়ে বিক্রেতাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডতায় জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মাদ্রাসা ছাত্র, মোবাইল ব্যবসায়ী ও ছাত্রলীগের ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনায় হাফেজ মাসুদুর রহমান(২০) নামে এক ছাত্র আহত হন। মঙ্গলবার ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সকালে রাস্তায় নেমে আসে তার ক্ষুব্ধ সহপাঠীরা।
মঙ্গলবার হাফেজ মাসুদুরের দাফন সম্পন্ন হয়।


বিচ্ছিন্ন হয় ঢাকা- চট্টগ্রাম যোগাযোগ

মঙ্গলবার সকাল থেকে বিক্ষুব্ধ মাদ্রাসা ছাত্ররা শহরের বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করে। এক পর্যায়ে মিছিল নিরয়ে রেল স্টেশনে ভাংচুর করে।  রেললাইনের স্লিপার খুলে, রেল লাইনের ওপর গাছের গুঁড়ি ফেলে ও আগুন দিয়ে রেলপথ অবরোধ করে।

এর ফলে, বেলা ১১টার দিকে কয়েক ঘণ্টার জন্য রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান  ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহকারী স্টেশন মাস্টার মাইনুল ইসলাম।

এ ঘটনায় দূর্ভোগে পড়ে হাজার হাজার যাত্রী।

বিক্ষুব্ধরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনে হামলা চালিয়ে টিকেট বিক্রির জন্য ব্যবহৃত কম্পিউটার, সিসি টিভি ক্যামেরা, স্টেশন মাস্টারের কক্ষ, সিগন্যালিং যন্ত্র, টিকিট কাউন্টার, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বিশ্রামাগারসহ প্রায় সকল কক্ষের আসবাবপত্র ও সরঞ্জাম ভাঙচুর করে ও আঙন ধরিয়ে দেয়। ছাত্রদের একটি অংশ সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনেও ভাঙচুর চালায়।


পুলিশ প্রত্যাহার ও বিজিবি মোতায়েন

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মাদ্রাসা ছাত্ররা  ছাত্রলীগের নেতাদের কয়েকটি মোটরসাইকেল ও  প্রাইভেটকার ভাঙচুর করে। এ সময় তাদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে।

তবে পুলিশই মাদ্রাসা ছাত্র মাসুদকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আনা হয়। এ বিষয়ে জেলা কওমী ছাত্র ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোশাররফ বলেন, ‘মাদ্রাসায় ঢুকে পুলিশ মাসুদুর রহমানকে মেরে ফেলেছ। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সদর থানার ওসির অপসারণ চাই’।

এমন দাবির মুখে সন্ধ্যার আগে বাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার তাপস রঞ্জন ঘোষ ও  ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকুল চন্দ্র বিশ্বাসকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে অকূস্থলে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

ওই সংঘর্ষে আহত স্থানীয় সাংবাদিক মাসুক হৃদয় বেনারকে জানান, ‘নিহত মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দিনভর সংঘর্ষের পর পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষকদের সমঝোতা হয়েছে। তাদের দাবি অনুযায়ী পুলিশের কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে’।

ঘটনা তদেন্তে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মাহবুবুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে ওই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেন পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এআইজি (গোপনীয়) মো. মনিরুজ্জামান পিপিএম।


পুলিশের সমালোচনা

সংঘর্ষের ঘটনায় উপস্থিত হয়েই পুলিশের নির্বিচারে গুলি, টিয়ার সেল ছোঁড়ার সমালোচনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, পুলিশের এই কার্যকলাপ অনেক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সংঘর্ষকে উসকে দেয়।

যদিও কওমী মাদ্রাসা-প্রধান এলাকায় এ ধরনের সংঘর্ষের পরিস্থিতি নতুন নয়, তবু পুলিশকে আরো ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা উচিত ছিল বলেই মত দিয়েছেন অনেকে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাহফুজুল হক মারজান বেনারকে বলেন, ‘যেকোন মব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার সেল নিক্ষেপ ও গুলি ছোড়া যেন এখন নিয়মিত। পুলিশকে এই কৌশল পরিবর্তনের সময় এসেছে। পুলিশের প্রশিক্ষণেও এই কৌশলগুলোর বাইরে কোন কিছু শেখানো হয় না। বিদেশেও মব দমনে নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আমাদের দেশের পুলিশেরও এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রেণে আরো উন্নত প্রশিক্ষণ দরকার’।

পুলিশ প্রত্যাহারের সমালোচনা করেও তিনি বলেন, এটা কোন শাস্তি নয়। এটা আলোচনা থেকে সরিয়ে রাখতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে কাজ থেকে দূরে রাখা মাত্র। মাসের বেতনও তিনি ঠিকমত পান, আবার কাজেও যোগ দেন কিছুদিন পর। তাই পুলিশের এই শাস্তি গ্রহণযোগ্য নয়। দায়িত্ব পালনে তাদের গাফিলতি প্রমান হলে যথোপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।