গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
2016.05.03
ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
দেশের মূল ধারার তিন ধরনের সংবাদমাধ্যমের জন্য তিনটি আলাদা আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যা নিয়ে গণমাধ্যম কর্মী ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, এসব আইন প্রণয়নের লক্ষ্য গণমাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা ও চাপের মুখে রাখা। অন্যদিকে সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, গণমাধ্যমের জন্য প্রচলিত আইনগুলোকে যুগোপযোগী করতে এসব আইন ও নীতিমালা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে যে তিনটি আইন নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা হচ্ছে; সেগুলোর মধ্যে রয়েছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য সম্প্রচার আইন প্রণয়ন, ছাপা পত্রিকার জন্য প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন এবং অনলাইন পত্রিকাগুলোর জন্য অনলাইন নীতিমালা।
“গণমাধ্যমের স্বাধীন কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে এমন কোনো আইনি, প্রশাসনিক, নীতি বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার থেকে বিরত থাকা উচিত,” বেনারকে জানান দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালা, সম্প্রচার আইন ও প্রেস কাউন্সিল আইনের সাম্প্রতিক সংশোধনী প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে যেসব ধারা মাত্রাতিরিক্ত ও নিবর্তনমূলক নজরদারির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে এবং তথ্য প্রকাশের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে, সেগুলো বাতিল করা উচিত।
নির্দেশ না মানলে পত্রিকা বন্ধ!
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়।আইন কমিশন এ বিষয়ে একটি সুপারিশ করে বলেছে, যদি কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থা প্রেস কাউন্সিলের রায় না মানে তাহলে সেই পত্রিকাটি সর্বোচ্চ ৩০ দিন বন্ধ রাখা যাবে।
প্রেস কাউন্সিল আইন কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে একমত নয়। নৈতিক বিচ্যুতির কারণে কোনো সংবাদপত্র, সম্পাদক, সাংবাদিক ও সংবাদ সংস্থাকে সতর্ক ও তিরস্কার করতে পারে কাউন্সিল।
প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, আইন সংশোধন করে সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থা বন্ধ রাখার ক্ষমতা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁরা সুপারিশ করেননি। আইন কমিশনের সুপারিশ নিয়ে প্রেস কাউন্সিলের বৈঠকে বসে বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে।
চেয়ারম্যান বলেন, “এটা সত্য যে, অনেক পত্রিকা প্রেস কাউন্সিলের আদেশ মানে না। এ জন্য কিছু ক্ষমতা কমিশনের কাছে থাকা উচিত। তাই বলে তিনি ৩০ দিন সংবাদপত্র বন্ধ রাখার পক্ষে নন।”
আইন কমিশনের সিনিয়র গবেষণা কর্মকর্তা ও যুগ্ম জেলা জজ হাবিবুর রহমান গতকাল এক ব্যাখ্যায় বলেন, শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ও প্রেস কাউন্সিলের আদেশ পালনে বাধ্য করার ক্ষেত্রে জরিমানাসহ সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থাকে সাময়িক বন্ধ রাখার ক্ষমতা প্রেস কাউন্সিলকে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এই সুপারিশ মানতে সরকার বাধ্য নয়।
সম্প্রচার আইন না মানলে জেল
জাতীয় সম্প্রচার আইনের বিধিবিধান বা প্রবিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড, কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। এ ছাড়া লাইসেন্স ছাড়া সম্প্রচারমাধ্যম পরিচালনা করলে জরিমানা সর্বোচ্চ ১০ কোটি টাকা।
ওয়েবসাইটে খসড়াটি প্রকাশ করে এর ওপর মতামত নিচ্ছে তথ্য মন্ত্রণালয়, যা শেষ হবে ৪ মে।
“একটি ঘটনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির অভিযোগের ভিত্তিতে গণমাধ্যম মালিকের জেল-জরিমানা হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ওই খবরটি যদি সত্য হয়, তখনকার পরিস্থিতি ভেবে দেখা দরকার,” বেনারকে জানান বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের পরিচালক (বার্তা) শাইখ সিরাজ।
অনলাইন নীতিমালা
জাতীয় অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার প্রাথমিক খসড়া তৈরির কাজ চলছে।
সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের সংগঠন নোয়াব মনে করে, প্রচলিত সব নিয়ম–কানুন মেনে যাঁরা পত্রিকা প্রকাশ করছেন তাঁদের অনলাইন সংস্করণের জন্য আলাদা নিবন্ধন যুক্তিসংগত নয়।
তবে সরকার বলছে, দেশে যে কেউ চাইলে অনলাইন পত্রিকা চালু করতে পারছে। এগুলোর ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোনোরকম হিসাবও নেই। তাই অনলাইন গণমাধ্যমের কার্যক্রম দেখভালের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হবে।
অনলাইন গণমাধ্যমের জন্য তৈরি খসড়া নীতিমালায় সশস্ত্র বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা অবমাননাকর তথ্যের প্রচার নিষিদ্ধ হচ্ছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো বিদ্রোহ এবং হিংসাত্মক ঘটনার তথ্য-উপাত্ত প্রচার করা যাবে না। এ ছাড়া প্রতিটি অনলাইন মাধ্যমকে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলো যা বলছে
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে এমন আন্তর্জাতিক সব সংস্থা ও সংগঠনের সূচকে দেখা গেছে বাংলাদেশে স্বাধীন ও মুক্ত গণমাধ্যম চ্যালেঞ্জের মুখে।
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্ত গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে যে দেশগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ সেই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৫ সালে স্বাধীন গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্টে ৭ কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, সংবাদপত্র এবং মতপ্রকাশের পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপও এ দেশের অন্যতম মানবাধিকার সমস্যা।
“বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মধ্যবর্তী অবস্থানে আছে। তথ্য ভান্ডারে অধিগম্যতা বাড়লেও মৌলবাদীদের হুমকি রয়ে গেছে। বলা যায় বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে পুরোপুরি মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না,” বেনারকে জানান সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন নয়। এটা আংশিক স্বাধীন।
তবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বেনারকে বলেন, “এই মুহূর্তে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। এখন পত্রিকার প্রকাশনা নির্বাহী আদেশে বন্ধ করা যায় না। সাংবাদিকদের লেখনীর জন্য আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারে না।”
সাবেক ওই সাংবাদিক নেতার মতে, গণতন্ত্রের বিকাশ হলে সাংবাদিকদের স্বাধীনতাও বাড়বে। তবে গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সাংবাদিকদের কাজও করতে হবে।