দেশে ফিরল আরো ৬৫ অবৈধ অভিবাসী, তিন পাচারকারী গুলিবিদ্ধ
2015.06.15
“আমি ভাগ্যবান, আমি বেঁচে আছি।”- অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশি মোহাম্মদ মিনহাজউদ্দিনের প্রতিক্রিয়া এটি। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য যিনি সাগরে পাড়ি দিয়েছিলেন, ভাগ্য পরিবর্তন তো দূরের কথা, বেঁচে থাকাকেই সৌভাগ্য মনে করছেন তিনি।
মিনহাজ জানান, গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় দালালরা চুয়াডাঙ্গা থেকে যশোর হয়ে তাকে চট্টগ্রামে এনে নৌকায় তোলে। তিনি টানা ৩৯দিন নৌকাতে এবং ৩১ দিন শরনার্থী ক্যাম্পে ছিলেন।
বৃহস্পতিবার মিনহাজসহ ১৮ জন বাংলাদেশিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং সোমবার থাইল্যান্ড থেকে ৪৭ জনকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে।
আটকে পড়াদের এক মাসের মধ্যে ফেরত আনার বিষয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সাঈদা মুনা তাসনিম।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এ কাজে বাংলাদেশকে সহায়তা করছে। এসব বাংলাদেশি অভিবাসীদের উদ্ধারের পর ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশ এবং থাইল্যান্ডের শঙ্খলা প্রদেশের শরনার্থী শিবিরে রাখা হয়েছিল।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে আইওএম’র কর্মকর্তারা তাদেরকে গ্রহণ করেন। সেখানে তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর তাদেরকে বাড়ি পাঠানো হয়।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরুনোর পথে চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দা ২০ বছর বয়সী মিনহাজ বেনারকে জানান, “মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে মাঝ সাগরে নৌকা থামিয়ে বাড়িতে ফোন করে মুক্তিপণ চাইত পাচারকারীরা। যারা টাকা দিতে অস্বীকার করত বা নির্দিষ্ট সময়ে টাকা দিতে না পারত, তাদেরকে মারধর করে এমনকি চাকু দিয়ে আঘাত করে সাগরে ফেলে দেওয়া হত।”
“কক্সবাজার থেকে রওনা দেওয়ার ৬দিন পরে আমরা থাইল্যান্ড সীমানায় পৌঁছাই। সেখানে যাওয়ার পর দালালদের আসল রুপ দেখি। তারা আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে ফোন করে মুক্তিপণ চাইতে থাকে। খাওয়া বলতে ২/১ দিন পর পর একটা রুটি আর একটু পানি ছাড়া কিছুই জুটত না।”- বলেন মিনহাজ।
১৮ জনের এই দলে কয়েকজন কিশোরের দেখাও মেলে। তারাও ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলো মালয়েশিয়া। সেই আশায় সাগরে নামলেও দীর্ঘদিন প্রায় অনাহারে থাকা, পাচারকারীদের নির্যাতন, চোখের সামনে সহযাত্রীকে মরতে দেখা, তাদেরকে যেন মৃত্যুর চেহারাই দেখিয়ে এনেছে।
যশোরের কিশোর গোলাম রসুল বলেন, “বিরাট জাহাজে (মুলত: বড় নৌকা) আমাদের মত কতজন লোক ছিল জানিনা, তবে এত বেশি ছিল যে, সবাইকে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হত। যেভাবে গরু-ছাগল নেওয়া হয়, সেভাবে। সেখানে বসার জায়গা হত না। আবার নড়া চড়া করলেও সারাক্ষণ মারধর করত পাচারকারীরা।”
১৬ বছর বয়সী এই কিশোর আত্মোপলোব্ধি থেকে বলেন, “দেশে ভিক্ষা করে খাব, কিন্তু আর কোনদিন বিদেশ যাব না। যে টাকা দালালকে দিয়েছি, সেই টাকা দিয়ে দেশেই ছোট্ট কোন ব্যবসা শুরু করলে শান্তিতেই থাকতে পারতাম।”
জানা যায়, পাচারকারীরা একেক জনকে একেকভাবে বুঝিয়ে মালয়েশিয়া যেতে রাজি করায়। কারো কাছে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ নিয়ে, কাউকে মালয়েশিয়া গিয়ে, আবার কাউকে কাউকে চাকরি পাওয়ার পর অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজি করায় তারা। তাদের কথায় বিশ্বাস করে অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যেতে নৌকায় ওঠার পরেই পাচারকারীদের আসল রুপ বোঝা যায়।
সে মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য দুই লাখ টাকা পাচারকারীদের দিয়েছে বলে বেনারকে জানান।
পাচারের শিকার বাংলাদেশিদের এই ফেরত আনার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
“ইন্দোনেশিয়ার পাশাপাশি থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায উপকূলে যারা উদ্ধার হয়েছেন, তাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব যাচাই বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও অব্যাহত রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাদেরকেও ফেরত আনা হবে।”- বেনারকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া)আসুদ আহমেদ।
“ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডে উদ্ধার হওয়া অবৈধ অভিবাসীর তালিকা নিয়ে বাংলাদেশ যাচাই করে দেখছে।” বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে আইওএম’র মুখপাত্র অনিন্দ্য দত্ত বেনারকে বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত ২৪৭ জনকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের মধ্যে ১৮জনকে দেশে এনে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করা হলো। এখন ছোট ছোট দলে ভাগ করে অন্যদেরও ফেরত আনা হবে। তবে এই প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময় লাগছে বলে কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছেন।
কয়েকদিন আগে মিয়ানমার উপকূলে উদ্ধার হওয়াদের মধ্যে দেড়শ জনকে বাংলাদেশি চিহ্নিত করে ফেরত আনা হয়েছে। তাদের মধ্যে দুই জন রোহিঙ্গা শরনার্থীও ছিলেন।
ফেরত আনার এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে দেশে এনে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত সাইদা মুনা তাসনিম। এছাড়া অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার পরিণতি সম্পর্কেও সচেতন করে তোলার প্রতি জোর দেন তিনি।
তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি বিদেশে যাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করছে এসব মানুষ। অথচ এই অর্থ দেশে বিনিয়োগ করে লাভজনক কিছু করা সম্ভব। এই ধারণাটি তাদের মধ্যে নেই।এসব বিষয়ে তাদেরকে ধারণা দিতে হবে।
দুই হাজার পাসপোর্টসহ পাচারকারী আটক
এদিকে রাজধানী ঢাকায় বিদেশে মানব পাচারের অভিযোগে এক নারীসহ ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তাদের কাছ থেকে ২ হাজার ১৬০টি জাল পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে তারা। গত মঙ্গলবার রাতে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার একটি ট্রাভেল এজেন্সি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়, জানান র্যাবের সহকারী পরিচালক মেজর মাকসুদুল আলম।
তিনি জানান, প্রতারিত ব্যক্তিদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় ‘গোলাম রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সী অ্যান্ড ট্র্যাভেলস’ কার্যালয়ে অভিযান চালায় র্যাব।
এ চক্রটি দীর্ঘদিন থেকেই বিভিন্ন দেশে নারী ও পুরুষদের পাচারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তাদের কাছে থাকা অবৈধ পাসপোর্টগুলো জব্দ করা হয়েছে। পাসপোর্টগুলো বিভিন্ন জনের নামে তৈরি করা। ওই ট্রাভেল এজেন্সির কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
আটকের পর সকলকের সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। তবে তাদের সঙ্গে আলপের কোন সুযোগ ছিল না।
তিন মানবপচারকারী গুলিবিদ্ধ
সাতক্ষীরা সীমান্তের শিকড়িতে রোববার সন্ধ্যায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’তিন ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পুলিশ জানায়, গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিরা মানবপাচারকারী। বন্দুকযুদ্ধে তিন পুলিশ সদস্যও আহত হন।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদ শেখ জানান, একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে কয়েকজন মানবপাচারকারী বৈঠক করছেন এমন খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল সেখানে গেলে টের পেয়ে পাচারকারীরা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলিবর্ষন করলে তিন মানবপাচারকারী গুলিবিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থল থেকে একটি দেশি রিভলবার ও পাঁচটি গুলি জব্দ করা হয়েছে। মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে মামলা হয়েছে।
ওসি আরো জানান, মানবপাচারকারীরা সম্প্রতি ভারতে ২৮ জন বাংলাদেশিকে পাচার করে।