‘সংখ্যালঘুদের জমি দখলে মন্ত্রী-এমপিসহ ক্ষমতাবানরা জড়িত’
2016.01.08

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় দুর্বল ও সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল এবং তাদের ওপর নির্যাতনে ক্ষমতাসীন সরকারের সাংসদ-মন্ত্রীদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব নির্যাতনে অতিষ্ঠ অনেকেই ইতিমধ্যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখল ও তাদের ওপর হামলার বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ আনা হয়। সেখানে সম্পত্তি দখল করা কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদের নামও প্রকাশ করা হয়।
বারবার অভিযোগ সত্তেও সরকারের পক্ষ থেকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানান ভুক্তভোগীরা। আর যাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠেছে তারা বরাবরের মত নিজেদের নির্দোষ দাবি করছেন।
সম্পত্তি দখলে সরাসরি জড়িত যেসব মন্ত্রী-সাংসদ
সংবাদ সম্মেলনে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘সরকার দলীয় মন্ত্রী-এমপিরা জড়িত সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং তাদের উপর নির্যাপতন চালাচ্ছে। ঠাকুরগাঁওয়ের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমি দখল ও হামলার বিষয়ে সাংসদ দবিরুল ইসলাম সরাসরি জড়িত। এ ছাড়া ফরিদপুরে এ ধরনের একটি ঘটনায় একজন মন্ত্রীর নামও এসেছে।’
প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুরের ভাজনডাঙ্গার জমিদার সতীশ চন্দ্র গুহ মজুমদারের বাড়ি দখলে নিয়ে পুরোনো ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ ঠাকুরগাঁও-ফরিদপুর ছাড়াও পিরোজপুরের সাংসদ এ কে এম এ আউয়াল একইভাবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করছেন। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ক্ষত্রিয় পরিবারের ৫৫টি পরিবারের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন হচ্ছে। এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমপি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার।
দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন নির্যাতিতরা
ক্ষমতাসীনদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নির্যাতিতরা বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়ছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগীদের কয়েকজন নির্যাতনের বর্ণনা দেন। ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী থেকে আসা জিতেন চন্দ্র সিং তার ভাই ভাকারাম সিংয়ের ওপর সংসদ সদস্য ‘দবিরের ছেলে মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে হামলার’ বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘তারা জমি দখল করতে এসেছিল। এক পর্যায়ে তারা আমাদের ভাকারামকে পায়ে-পিঠে চাপাতি দিয়ে কোপায়। তাকে ঘিরে ধরে কীভাবে হামলা চালানো হয়েছিল- তা বুঝাতে পারব না।’
ওই হামলার পর তার ছেলে অভিলাল সিং এখন দিল্লি গিয়ে বসবাস করছে বলে জানান জিতেন চন্দ্র সিং।
এ প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হামলা যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সবলের অত্যাচারের কারণে দুর্বল ভাবছেন তারা দেশে থাকবেন না, এটা তো আমরা কোনোভাবে মেনে নিতে পারি না।’
সংবাদ সম্মেলনে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর ঘটনায় তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন প্রতিরোধ আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘জমি দখলকে কেন্দ্র করে গত ১৯ জুন স্থানীয় সংসদ সদস্যের ছেলের নেতৃত্বে অন্তত ৩০ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা করে। সন্ত্রাসীদের হামলায় অকুলচন্দ্র তার পরিবার নিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। আর সন্ত্রাসীদের হামলায় ভাকারাম সিংহসহ ৮-১০ জন আহত হন, সন্ত্রাসীরা কয়েকজন নারীকেও মারধর করে।’
প্রশাসন নির্বিকার!
সংখ্যা লঘুদের ওপর এসব নির্যা্তনের ঘটনা প্রসাশনের ‘চোখের সামনে’ ঘটলেও তারা দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নির্বিকার ভূমিকা পালন করে থাকে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ‘জোরপূর্বক ভূমিদখল, সহিংস হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে। পুলিশ এসব বিষয় জানলেও এখন পর্যন্ত এসব ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। কোনো নির্যাতনকারী গ্রেপ্তার হয়নি। বরাবরের মত স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার। তাদের এই ভূমিকা বিস্মিত করেছে।’
মন্ত্রী-এমপিদের সাফাই
এসব এমপি ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংখ্যা লঘুদের সম্পত্তি দখলের অভিযোগ নতুন নয়। তবে বরাবরের মতই তারা সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেদের পক্ষে সাফাই দিয়ে যান। এসব অভিযোগ সম্পর্কে এমপি দবিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি ছয়বারের নির্বাচিত এমপি হওয়ায় অনেকে ঈর্ষা করে আমার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য এ অপপ্রচার চালিয়ে থাকেন। জমি নিয়ে আমার সঙ্গে যে বিরোধ ছিল, তা মিটমাট হয়ে গেছে’।
আর ফরিদপুরের জমিদারবাড়ি সম্পর্কে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এর আগে একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জমিদারবাড়িটি আমাদের পাশের বাড়ি। আমরা ৭০ বছর ওই বাড়ি পাহারা দিয়ে রেখেছি। অন্য এক ব্যক্তি জাল কাগজপত্র তৈরি করে ওই বাড়ি দখল করেছিল। আমরা তা দখলমুক্ত করি। পরে বাড়ির প্রকৃত মালিক অনেক পীড়াপীড়ি করায় আমরা ন্যায্য নাম দিয়ে ওই বাড়ি কিনেছি।’
সরকার দলীয় প্রধানের হস্তক্ষেপ দাবি
বারবার অভিযোগ করা সত্তেও যখন স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা না পেয়ে সরকার প্রধান ও সরকার দলীয় প্রধানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও তাদের সম্পদ রক্ষা জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত বেনারকে বলেন, “সংখ্যালঘুরা কোনো দলের ভোট ব্যাংক নয়। তারাও এদেশের নাগরিক। তাই দখলদারদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন ও দ্রুত বিচার আইনে ব্যবস্থা নিতে হবে। তার জন্য এ বিষয়টিতে সরকার প্রধান ও সরকারী দলের প্রধানের একটি নজরদারি রাখা উচিত। সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে যারা যুক্ত, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।”