কেউ অর্থ পাচার করলে তার সম্পত্তি ক্রোকের বিধান
2015.08.20
কোনো ব্যক্তি অর্থ বা সম্পদ বাংলাদেশ থেকে পাচার করলে, পাচার করা ওই অর্থ বা সম্পদ ফেরত আনা না গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তির দেশে থাকা সম্পদ বা অর্থ থেকে পাচার করা অর্থসম্পদের সমপরিমান অর্থ-সম্পদ ক্রোক করার বিধান আসছে।
এছাড়া এ ধরনের অপরাধে অর্থদণ্ডের পরিমাণ দ্বিগুণ করা, একাধিক সংস্থার যৌথ তদন্তের সুযোগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে শক্তিশালী করার বিধান রেখে 'মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) আইন, ২০১৫'-এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।
গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কেবল ঘুষ ও দুর্নীতিসংক্রান্ত অপরাধ তদন্তের ভার দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে রেখে 'দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১৫' সংশোধন করার প্রস্তাবে সায় দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
যে সব পরিবর্তন আসছে
২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে চার থেকে ১২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। সংশোধিত আইনে তা একই থাকলেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে অর্থদণ্ডে। এই অঙ্ক বাড়িয়ে ১০ লাখের জায়গায় ২০ লাখ টাকা করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। সেইসেঙ্গে পাচার হওয়া অর্থের কমপক্ষে দ্বিগুণ অথবা ২০ লাখ টাকার মধ্যে যেটি বেশি হবে সেই পরিমাণ জরিমানার কথা বলা আছে আইন সংশোধনীর খসড়ায়।
বর্তমান আইনে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দুদকের ওপর। ক্ষেত্রবিশেষে দুদক অন্য কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দিলেই কেবল তারা এ তদন্তে যুক্ত হতে পারত। অর্থাৎ বিদ্যমান মানি লন্ডারিং আইনে যৌথ তদন্তের বিধান নেই। সংশোধনীতে বিভিন্ন সংস্থার যৌথ তদন্ত ও মানি লন্ডারিং সম্পর্কিত অপরাধ তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) শক্তিশালী করার বিয়ষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
আইন সংশোধনীর খসড়ায় বলা হয়েছে, ঘুষ ও দুর্নীতিসংক্রান্ত মুদ্রাপাচারের ঘটনা ঘটলে তা তদন্তের দায়িত্ব দুদকের হাতে থাকবে। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থা তদন্তের দায়িত্ব নেবে। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে না পারলে পাচারের সমপরিমান অর্থ বা সম্পদের আর্থিক মূল্য অভিযুক্ত ব্যক্তির দেশে থাকা সম্পদ থেকে বাজেয়াপ্ত করে আদায় করার বিধান রাখা হয়েছে।
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, 'মানি লন্ডারিং অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত সম্পত্তি, অপরাধলব্ধ আয়, অর্থ বা সম্পত্তি চিহ্নিত করা সম্ভব না হলে দুর্নীতি দমন কমিশন বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার লিখিত আবেদনের ভিত্তিতে আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংস্থার অন্য অর্থ বা সম্পত্তি হতে সমমূল্যের অর্থ বা সম্পত্তি অবরুদ্ধ বা ক্রোক আদেশ প্রদান করিতে পারিবে।'
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা মানি লন্ডারিং আইনের খসড়া অনুমোদন প্রসঙ্গে বলেন, “দুর্নীতি দমন আইনের তফসিলে এখন বলা আছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর অধীন অপরাধসমূহ। এখানে সংশোধন করে বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর অধীন ঘুষ ও দুর্নীতিসংক্রান্ত অপরাধসমূহ।”
তিনি বলেন, “মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টা খুব জটিল। মানি লন্ডারিংয়ের অর্থে অন্য কোনো অপরাধ যেমন-খুন ইত্যাদি হলে সে ক্ষেত্রে যৌথ তদন্ত দলের প্রয়োজন থাকতে পারে; যার মধ্যে হয়তো পুলিশের লোক থাকবে, এনবিআরের লোক থাকবে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লোক থাকবে। যেখানে প্রয়োজন হবে যৌথ তদন্তদল করা যাবে-সেই বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
বিএফআইইউ শক্তিশালী করার প্রস্তাব
মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট 'বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট'কে (বিএফআইইউ) শক্তিশালী করা হচ্ছে। আইন সংশোধনের খসড়ায় তাদের আরো ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান আইনে এই ইউনিট বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অঙ্গ। ডেপুটি গভর্নরদের একজন এই ইউনিটের প্রধান হিসেবে কাজ করেন।
সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীন বিএফআইইউ স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। এ সংস্থার প্রধান সরকার কর্তৃক চার বছরের জন্য নিযুক্ত হবেন। তিনি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। সংস্থার প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের পদ ও মর্যাদার হবেন। সংস্থাটি হবে একটি কম্পোজিট বডি। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে অন্যান্য সংস্থার দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবেন। এ সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মানি লন্ডারিং ও জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধ-সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির কাছে প্রতিবেদন পাঠাবে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, “আইনে বিধান রাখা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতার মধ্যে একটা কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন থাকবে এবং কার্যকর স্বাধীনতা থাকবে। সংস্থার প্রধান যথেষ্ট অটোনমি নিয়ে এটা পরিচালনা করবেন। কিন্তু প্রশাসনিকভাবে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের আওতাধীন থাকবেন।”
‘ইতিবাচক, তবে প্রয়োজন কার্যকর প্রয়োগ’
এ আইনের সংশোধন বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি’র অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “এ সংশোধনের ফলে আইন ও কাঠামোগত দিক দিয়ে মুদ্রা পাচারের ব্যাপারটি আরও ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ তৈরি হলো। এর ফলে মুদ্রা পাচারের নেটওয়ার্ক ও এর সাথে যুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারির মধ্যে আনা যাবে। তবে হুন্ডির মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে”।
এছাড়া দেশের মানুষ যাতে মুদ্রা পাচারে নিরুৎসাহিত হয়, এ জন্য দেশেই অর্থ বিনিয়োগের যথেষ্ঠ সুযোগ তৈরি করতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই গবেষক।
পাচারের সমপরিমাণ অর্থ দেশীয় সম্পত্তি থেকে বাজেয়াপ্ত করা বিষয়ে তিনি বলেন, “সুনির্দিষ্টি তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটি করতে হবে। আইনের অপব্যবহার যাতে না হয় তা খেয়াল রাখতে হবে।”
‘স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের উপর অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে’
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট'কে (বিএফআইইউ) শক্তিশালী করা প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “আইনীভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানই স্বায়ত্বশাসিত কিন্তু তাদের উপর কর্তৃপক্ষের অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। তাই এই ইউনিটকে কার্যকর করতে যেকোন ধরনের অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। বিএফআইইউ’র সাফল্য নির্ভর করবে, কারা এখানে নিয়োগ পাচ্ছেন ও নিয়োগপ্রাপ্তরা কতটুকু স্বাধীন ও নির্ভীকভাবে কাজ করতে পারছেন তার উপর।”