হারানো ঢাকাই মসলিন ফিরে আসছে

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.02.05
BD-moslin জাতীয় জাদুঘরে শুরু হয়েছে মসলিন প্রদর্শনী। আগামী ৩ মার্চ পর্যন্ত সেখানে দর্শকেরা দেখতে পাবেন মসলিন-সংক্রান্ত শিল্পকর্ম।
বেনার নিউজ

যাদুকরী ঢাকাই মসলিন  হারিয়ে গেছে শতবছর আগে। ইতিহাসের  অংশ  হওয়ার পর সেই মসলিনকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে । দৃক নামে ঢাকার  একটি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে একটি মসলিন শাড়ি তৈরী করার কথা।

ঢাকার দৃক, আড়ং ও জাতীয় জাদুঘরের যৌথ আয়োজনে জাতীয়  জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে শুরু হয়েছে মসলিন প্রদর্শনী। আগামী ৩ মার্চ পর্যন্ত সেখানে দর্শকেরা দেখতে পাবেন মসলিন-সংক্রান্ত শিল্পকর্ম। জানা যাবে মসলিনকে ঘিরে নানা তথ্য, গল্প ও ইতিহাস।

“মসলিন তৈরির কাজটি ছিল ভীষন জটিল, কঠিন, সময়সাধ্য- তারচেয়েও বড় কথা,  সেটা তৈরির জন্য দরকার হতো অসামান্য নৈপুণ্য আর পরম ধৈর্য, “ বেনারকে জানান দৃকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম।

এটা তৈরি হতো ‘ফুটি কার্পাস’ নামের একধরনের সূক্ষ্ম তুলা থেকে।  

দৃকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম ২০১৪ সাল থেকে এ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।

একপযায়ে ভারতের জয়পুরে ফুটি কার্পাসের কাছাকাছি প্রজাতির তুলার বীজ পান। সেই তুলা থেকে তৈরি হয়েছে নতুন এই মসলিন কাপড়, যার মান ঢাকাই মসলিনের কাছাকাছি বলে মত দিয়েছেন  বস্ত্র  প্রকৌশলীরা ।

মসলিন কাপড় এত মিহি ছিল যে ৪০ হাত লম্বা ও ২ হাত চওড়া এমন একটি কাপড় একটা ছোট আংটির মধ্যে দিয়ে অনায়াসে চালাচালি করা যেত। ৫০ মিটার লম্বা মসলিন কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেত।

এখানেই শেষ নয়, একবার শাহজাদী জাহানারা আব-ই-রাওয়ানের সাতটি জামা পরে আওরঙ্গজেবের কাছে গেলেন। তখন সম্রাট রাগত স্বরে তাকে বলেন, তোমার কি কাপড়ের অভাব হয়েছে, গা দেখা যাচ্ছে কেন? উল্লেখ্য, আব-ই-রাওয়ান নামের মসলিন ছিল খুবই সূক্ষ্ম ও মিহি।

'India of Ancient and Middle Age' বইটিতে পাওয়া যায়, ঘাসের ওপর বিছানো একটি সুদীর্ঘ মসলিন শাড়ি নাকি একটা গরু খেয়ে ফেলেছিল। এর কারণ ছিলো কাপড়টির স্বচ্ছতা। অবশ্য গরুটির মালিককে তার জন্য দন্ডিত করা হয়।

মসলিন শব্দটি এসেছে  ইরাক থেকে । দেশটির  প্রখ্যাত ব্যবসা কেন্দ্র মসূলে তৈরি হত সূক্ষ্ম সব কাপড় । তাই ইংরেজরাই আমাদের এই সূক্ষ্ম কাপড়কে নাম দিয়েছিলেন মসলিন।

মুঘল আমলে সতেরো শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল ঢাকার সোনারগা আর তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোয়। এই মসলিন রপ্তানি হতো ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

ইতিহাস  থেকে জানা যায়, মসলিন কাপড়ের ঐতিহ্য বহু বছরের পুরানো। মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই নাকি এই মসলিনের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে নানাদিকে ।  

সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি থেকে কিছু দূরে বাজিতপুরে জন্মাতো উচুঁমানের কার্পাস আর তাই থেকে তৈরি হতো সেই জগৎ বিখ্যাত মসলিন।

জানা যায় ঢাকাতে সাতশ' ঘরের বেশি ছিলো এই মসলিন কারিগর। মসলিন তৈরি করার জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা বা কার্পাস। এই কার্পাস জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে। কাপাসিয়া জায়গাটির নামটাও নাকি এসেছে এই কার্পাস থেকে।

মসলিন কাপড় বুনতে সাধারনত মেয়েরাই সুতা কাঁটা আর সূক্ষ্ম সুতা তোলার কাজগুলো করতো। সুতা তোলার সময় কম তাপ এবং আর্দ্রতার দরকার হতো। তাই একেবারে ভোর বেলা আর বিকালের পরে এ কাজ করা হতো।  

এই কাপড় ধোয়াটাও নাকি এক বিশেষ যত্নের ব্যাপার ছিলো। সম্রাট আকবর এর আমালে সোনারগাঁ'র কাছে এগোরো সিন্ধুর পানি কাপড় ধোয়ার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। আসলে এটা যে শুধু পানির গুনে হতো তা নয়, এর সাথে ছিল ভাল ক্ষার বা সাবান আর ধোপার দক্ষতা। কোন কোন মসলিনে ছুঁচের বা চিকনের কাজও করা হতো। মসলিনের মূল্যমান নির্ধারিত হত সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশা বিচারে।

সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। সূক্ষ্মতা, স্বচ্ছতা বা মানের ওপর ভিত্তি করে মসলিনের বিভিন্ন নামকরণ করা হতো। যেমন, মলমল (সূক্ষ্মতম বস্ত্র), তানজেব (দেহের ভূষণ), আবই-রওয়ান (প্রবহমান পানির তুল্য বস্ত্র), খাস (মিহি বা জমকালো), শব-নম (ভোরের শিশির), আলাবালি (অতি মিহি), ডোরিয়া (ডোরাকাটা) ইত্যাদি।

"মলবুস/মলমল খাস" ছিল সবচেয়ে নামী, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হত এই মসলিন। দশ গজ লম্বা আর এক গজ চওড়া মলমল খাসের ওজন হত মাত্র ছয় তোলার মতো, যা অনায়াসে ছোট্ট একটা আংটির ভিতর দিয়ে গলে যেত!

মলবুস খাসের সমগোত্রীয় আরেকটি মসলিন "সরকার-ই আলা"। দশগজ লম্বা আর একগজ চওড়া 'সরকার-ই আলা'-র ওজন হত দশ তোলার মতো। ঝুনা মসলিনে সুতার পরিমান থাকতো কম- দেখতে হত অনেকটা জালের মত। ঝুনা হিন্দী শব্দ যার অর্থ 'সূক্ষ্ম'।

নকশা করা মসলিনকে বলা হতো জামদানি, কিন্তু আজকের জামদানির সাথে আদি জামদানির বলতে গেলে কোনো মিলই পাওয়া যাবেনা।

১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রপ্তানী করতো। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিলো প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন।

পরবর্তীতে মসলিন রপ্তানীর ব্যবসা প্রায় পুরোটাই করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রপ্তানী হত মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে।

পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করতো। জনশ্রুতি আছে,  ইংরেজরা  মসলিন তাঁতীদের আঙুল কেটে ফেলতো।

আবার এও শোনা যায় যে- তাঁতীরা নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলতো, যাতে করে এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়।  

১৮৪৪ সালে মসলিনের  বিলুপ্তির কারন পর্যালোচনা করেন  ঢাকার কমিশনার আই. ডানবার। তার  মতে মূল কারণগুলো ছিলঃ

এক,  ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সস্তায় সুতা আর কাপড় উৎপন্ন হতে থাকে। ফলে দামি মসলিনের চাহিদা কমে যায়।

দুই,  বিলেতের সস্তা সুতা ঢাকায়,  ভারতে আসতে থাকে,  সে থেকে তৈরি হতে থাকে কাপড়,  হারিয়ে যেতে থাকে মসলিন।

তিন, বিলাতে ঢাকাই মসলিনের ওপরে উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়, ফলে মসলিনের দাম ওখানে বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। স্বভাবতাই বিক্রি কমে যায় মসলিনের।

মসলিনের পড়তির সময়টায় পতন ঘটতে থাকে বাংলার  নবাব-সম্রাটদেরও। তাছাড়া মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী-কেউই এ শিল্প রক্ষা কিংবা প্রসারে কোন সময়ই তেমন কোন উদ্যোগ নেননি, সব সময় চেষ্টা করেছেন কিভাবে কৃষক-তাঁতীদের যতটা সম্ভব শোষণ করে নিজেরা লাভবান হওয়া যায়।

“বাংলার নানা ঐতিহ্যবাহী জামদানী, টাঙ্গাইল, রাজশাহী সিল্ক, মিরপুরী কাতান, খাদি ও আরও নানা রকম বর্ণ ও বৈচিত্রের শাড়ী এখনো টিকে আছে। মসলিন যদি সত্যিই  ফিরে আসে তা একটি বড় ব্যাপার হবে, “ বেনারকে জানান মিরপুর ব্যানারসি পল্লীর শাড়ি ব্যবসায়ী  মোহাম্মদ  হানিফ ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।