ধনকুবের মুসা ১২ বিলিয়ন ডলারের তথ্য দেবেন দুদককে!
2016.01.28
স্বঘোষিত ধনকুবের ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের সুইস ব্যাংকে ১২ বিলিয়ন ডলার জব্দ থাকা নিয়ে রহস্য কাটছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত প্রায় ছয় মাস ধরে তাঁর এই অর্থের উৎস খোঁজার চেষ্টা করলেও মুসা একেক সময় একেক ধরনের তথ্য দিয়ে আসছেন।
সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার দুদকে হাজির হয়ে তিনি জানিয়েছেন, নিজের হিসাব নম্বর এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য খুব শিগগির তিনি দুদকে জমা দেবেন।
তথ্য প্রদানে অসহযোগিতার অভিযোগে মামলা করা হতে পারে—এমন আশঙ্কায় মুসা দুদকে যান, এ অপরাধে ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মুসার অর্জিত বিশাল ধন-সম্পদ ও বিলাসিতার কল্পকাহিনীর কারণে তাঁকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ পর্যন্ত প্রকাশিত অনেক প্রতিবেদনের কারণে তিনি রহস্যঘেরা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
“অনিয়মিত লেনদেনের কারণে ওই অর্থ জব্দ অবস্থায় রয়েছে। এ বিষয়ে সেখানকার আদালতে মামলা চলছে,” সুইস ব্যাংকে ‘জব্দ’ ১২ বিলিয়ন ডলার প্রসঙ্গে গতকাল সাংবাদিকদের এ কথা বলেন মুসা।
বেলা ১১টা থেকে একটা পর্যন্ত মুসা বিন শমসেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে একটি দল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মুসা সাংবাদিকদের বলেন, “আমি দুদককে সব তথ্য দিয়েছি।”
“খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুসা সংশ্লিষ্ট সব তথ্য দুদককে সরবরাহ করার কথা জানিয়েছেন। মিথ্যা তথ্য দিলে কিংবা তথ্য দিতে অসহযোগিতা করলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বেনারকে জানান দুদকের কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন।
২০১৫ সালের ৭ জুন সম্পদ বিবরণীতে মুসা বিন শমসের জানান, সুইস ব্যাংকে তাঁর ১২ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৯৩ হাজার ছয় শ কোটি টাকা) ‘ফ্রিজ’ অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়াও ওই ব্যাংকের ভল্টে ৯০ মিলিয়ন ডলার দামের (বাংলাদেশি প্রায় সাত শ কোটি টাকা) অলংকার জমা রয়েছে।
বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, গাজীপুর ও সাভারে তাঁর নামে প্রায় এক হাজার দুই শ বিঘা সম্পত্তি রয়েছে। এসব জমির মূল্য প্রায় ১২ শ কোটি টাকার বেশি। বেশির ভাগ সময় দেশের বাইরে থাকায় এসব সম্পত্তির খাজনা পরিশোধ করে নামজারি করা সম্ভব হয়নি বলে জানান মুসা।
মুসার দেওয়া তথ্য যাচাই করতে দুদকের চাহিদা অনুযায়ী সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু চিঠির উত্তরে ব্যাংকটি জানিয়েছে, সেখানে ওই নামে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই।
সুইজারল্যান্ড কর্তৃপক্ষের জবাব পাওয়ার পর প্রকৃত তথ্য জানতে মুসাকে আবারও দুদকে তলব করা হয়। নোটিশে মুসাকে গত ১৩ জানুয়ারি সকাল দশটায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হলেও তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ওই দিন দুদকে যাননি।
“একদিকে তিনি দুদকের কাছে বিপুল সম্পত্তির হিসাব দিয়েছেন, আবার এও বলছেন, এসব সম্পত্তি তাঁর দখলে নেই। তিনি বিদেশে আটক ১২ বিলিয়ন ডলারের যে তথ্য দিয়েছেন, সেখান থেকেও এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না,” বেনরাকে জানান দুদক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান।
দুদকের নজরে পড়লেন যেভাবে
২০১৪ সালের জুন মাসে বিজনেস এশিয়া নামের একটি সাময়িকীতে মুসাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সূত্রে ওই বছরের ৩ নভেম্বর মুসার সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। ১৮ ডিসেম্বর প্রায় ৪০ জন ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর বহর নিয়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হন তিনি। পরে দুদকের অনুসন্ধান দলটি মুসার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ড্যাটকোতে গিয়ে তাঁকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে মুসা দাবি করেন, বিদেশে ব্যবসার মাধ্যমেই তিনি ১২ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন। সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাক, মিসর, সিরিয়া ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিরক্ষা ক্রয় সংক্রান্ত পাওনা পরিশোধের অর্থ ওই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে সুইস ব্যাংকে তাঁর অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।
এরপর তিনি তাঁর সম্পদ বিবরণীতেও এ বিষয়টি উল্লেখ করেন। এরপর আটঘাট বেঁধে নামে দুদক।
বিটিভির কৃতি বাঙালি!
গত বছর আগস্টে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগের দিন রাত সাড়ে আটটায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ‘চাঁদ আনন্দ’ অনুষ্ঠানে মুসা বিন শমসেরকে কৃতি বাঙালি হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। এরপর তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
এমন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে ‘কৃতী বাঙালি’ উপাধি দিয়ে সরকারি প্রচারমাধ্যম বিটিভিতে অনুষ্ঠান করায় পাঠক ও সুধীজনের মধ্যেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ সেলিমের বেয়াই মুসা বিন শমসের।
সব সময় আলোচনায় ছিলেন
মুসা বিন শমসের ড্যাটকো গ্রুপের চেয়ারম্যান যিনি বাংলাদেশের ‘বিজনেস মোগল’ নামে পরিচিত। তাকে ‘প্রিন্স মুসা’ বলা হয়। তিনি অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবেও বিতর্কিত।
১৯৫০ সালের ১৫ অক্টোবর তিনি ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শমসের আলী মোল্লা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।
১৯৯৪ সালে মুসা যখন ব্রিটেনের লেবার পার্টিতে ৫ মিলিয়ন পাউন্ড দান করতে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখনই তিনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় আসেন। তিনি ব্রিটেনের নাগরিক না হওয়ায় তাঁর প্রস্তাবটি তখন গ্রহণ করা যায়নি। তবে সমালোচকেরা বলেন, এই টাকা দিতে হবে না বলেই তিনি এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
আশির দশকে ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ‘দ্যা হিন্দু’ এবং ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ প্রিন্স মুসাকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ইচ্ছে প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, “৩ বিলিয়ন ডলার আমার জন্য বড় কোনো টাকা নয়। যত দিন পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন না হবে তত দিন আমি সরকারকে সহায়তা দেব, তাদের সঙ্গে জড়িত থাকব।”
জনশ্রুতি আছে, মুসা হীরক খচিত জুতো পরেন যার প্রতি জোড়ার দাম লাখ ডলার। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে রত্ন খচিত জুতো।
তাঁর সংগ্রহে অসংখ্য মূল্যবান স্যুট রয়েছে; প্রতিটি স্যুটের দাম পাঁচ থেকে ছয় হাজার পাউন্ড। তাঁর হাতের ঘড়ির ডায়াল এবং ব্রেসলেট হচ্ছে হীরক খচিত।
আরও জনশ্রুতি হচ্ছে, তিনি গোসল করেন নির্জলা গোলাপ পানিতে।
কেবলমাত্র বড় বড় অঙ্কের চেক সই করতে তিনি পুরো ২৪ ক্যারেট স্বর্ণ দিয়ে তৈরি মন্ট ব্ল্যাঙ্ক কলম ব্যবহার করে থাকেন। কলমটিতে সাড়ে সাত হাজার হীরক খণ্ড বসানো রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ২৬০ হাজার মার্কিন ডলার।
লন্ডনের দৈনিক দি সানডে টেলিগ্রাফ ম্যাগাজিনের এক জরিপে বলা হয়, এই আশ্চর্যজনক মূল্যবান ঘড়িটি পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত ঘড়ির মাঝে সর্বোৎকৃষ্ট।
লন্ডনের দি সানডে ম্যাগাজিনে তাঁকে আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘আন্তর্জাতিক রহস্য মানব’ বলে।
তাঁর গুলশানের বিলাসবহুল প্রাসাদোপম ভবনের পাহারায় নিয়োজিত আছে কেতাদুরস্ত ও সশস্ত্র নিরাপত্তা প্রহরী দল।
বিগত কয়েক দশক ধরে বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রগুলো প্রিন্স মুসাকে ফ্যাশন, স্টাইল এবং আভিজাত্যের মূর্ত প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে সুসজ্জিত ব্যক্তি (বেস্ট ড্রেসড ম্যান অব দ্যা ওয়ার্ল্ড) হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মুসার চারিত্রিক গুণাবলি নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। এসব প্রতিবেদনে তাঁকে ‘বিজনেস ম্যাগনেট’, ‘বিজনেস টাইকুন’, ‘প্রাচ্যের রাজকুমারের রূপকথার গল্প’, ‘মুকুটহীন এক রাজার প্রতিকৃতি'’, ‘বিশ্বের ধনী ও শক্তিধরদের বন্ধু’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুসা বিন শমসেরের ভূমিকা ছিল খুবই বিতর্কিত। এই নন্দিত বা নিন্দিত ব্যক্তি তাঁর নিজ এলাকা ফরিদপুরে ‘নূলা মুসা’ নামে এখনো পরিচিত।
“আমি স্বাধীনতাবিরোধী ছিলাম না। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতেই ছিলাম। এরপর ফরিদপুর চলে যাই,” মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মুসা গতকাল দুদক কার্যালয়ের সামনে এ কথা জানান।
তিনি দাবি করেন, ২১ এপ্রিল তাঁকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করে। ৯ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। মুসার দাবি, মৃতপ্রায় অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে মুক্তি দেয়।
তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন খবর ও স্থানীয় এলাকাবাসীর বক্তব্য অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন অত্যাচারের সঙ্গে মুসা জড়িত ছিলেন।