আধুনিক ভাস্কর্যের অগ্রদূত অভিমানী নভেরার বিদায়
2015.05.07
সবাই জানেন, অভিমানে দূরে চলে যান নভেরা। কিন্তু সেই অভিমানের কারণ তিনি নিজে কাউকে বলেননি।
দেশের আধুনিক ভাস্কর্যের অগ্রদূত নভেরা আহমেদ প্রায় ৪৫ বছর ধরে নিভৃতে প্যারিসে বসবাস করছিলেন। ৫ মে চলে চলেও গেলেন নীরবেই। স্থাপত্য শিল্পে ইউরোপীয় আধুনিকতার সন্নিবেশ ও দেশের শিল্প কলায় সেক্যুলার চিন্তার প্রয়োগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম নক্সা প্রণেতা ছিলেন তিনি। কেন তিনি শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি বা তাকে দেওয়া হয়নি সেটি এখনো রহস্যের মোড়কে। যেমনটি নভেরা নিজেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন এক রহস্যের খোলসে।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর হৃদকলমের টানে সংকলনটিতে লিখেছেন “হামিদুর রহমান চিত্রকর, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিকল্পনাকারী শিল্পী দু’জনের একজন, অপরজন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে শহীদ মিনারের নির্মাতা হিসেবে নভেরার নামটি সরকারি কাগজ থেকে ঝরে পড়ে।”
সামাজিক মাধ্যমে বিস্মৃত প্রায় এই খ্যাতিমান শিল্পীর প্রতি অবহেলার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছে ঢাকার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
“ভাস্করশিল্পের কিংবদন্তি ছিলেন নভেরা আহমেদ। তাঁর মুত্যতে শিল্পাঙ্গনের শূন্যতা সহজে পূরণ হবে না,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
দেশের অন্যতম এই ভাস্কর, বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের পথিকৃৎ জীবনের বড় অংশ লোকচক্ষুর অন্তরালেই কাটিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে অনেকটা অভিমান নিয়েই তিনি দেশ ত্যাগ করেন। দেশের আড়াল হওয়া এ ভাস্কর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকেই গেলেন না ফেরার দেশে।
নভেরা রেখে গেছেন তাঁর অসংখ্য শিল্পকর্ম, শিল্পকর্মের অসংখ্য গুণগ্রাহী। আর রেখে গেছেন স্বামী গ্রেগোয়া দ্য ব্রন্সকে।
নভেরা আহমেদ। নামেই যার পরিচয়। তাঁর জন্মনামের ‘নবাগত’বা 'নতুন' অর্থ বহনকারী এ ভাস্কর উন্মোচন করেছেন ভাস্কর্যের এক নান্দনিক রূপ আজীবন সৃষ্টি করেছেন নিখুঁত সব শিল্পকর্ম।
“এ ভাস্কর অনন্য ও অসাধারণ তার কাজের মসৃণতায়, যত্নে ও ভিন্নতায়। তাঁর সৃষ্টিতে নারীকে অন্যরূপে নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে নারী সরল, উদার, মৌন, সংকল্পবদ্ধ, শক্তিময়ী ও অনমনীয়,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রভাষক মাসুদা সুলতানা।
১৯৩০ সালের ২৯ মার্চ জন্ম গ্রহণ করেন নভেরা। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকারদীঘির উত্তর পাড়া। কলকাতার লরেটো স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন তিনি। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ ও চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনা করেছেন তিনি।
এরপর ১৯৫১ সালে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে তিনি লন্ডনে চলে যান । শিল্পমনা নভেরাকে পরিবারের ইচ্ছেতেই আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পাড়ি জমাতে হয় সেখানে। কিন্তু শৈশব থেকেই মনে লালন করেছেন ভাস্কর হওয়ার অদম্য ইচ্ছে। আর সে ইচ্ছেই তাকে পৌঁছে দেয় লন্ডনের সিটি অ্যান্ড গিল্ড স্টোন কার্ভিং ক্লাস ।
এর পরে যুক্ত হন ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স করেন। ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে পড়াশোনা করেন নভেরা।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অন্যতম রূপকার নভেরা কাজের নেশায় প্রাণের টানে দেশে ফেরেন ১৯৫৬ সালে। ঢাকায় তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ চলছিল। সেখানে যুক্ত হন তিনি। নভেরা আহমেদ প্রয়াত ভাস্কর হামিদুর রহমানের সঙ্গে শহীদ মিনারের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের কাজে যুক্ত হন।
এর পর নভেরার নকশা বাদ দিয়েই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি হয়। এ বিষয়টি সবাই জানলেও কেন এমন ঘটল তা আজও রহস্যজনক।
ভাস্কর নভেরার কাজে যে দিকটি প্রাধান্য পেয়েছিল তা হলো নারীর অতুলনীয় মাতৃমূর্তি। নভেরা আহমেদের অন্যতম কয়েকটি শিল্পকর্ম হলো ‘মানবতা’ ‘সূর্যাস্ত’ ‘বর্ষাকাল’‘অপুর ভুবন’ ‘আলোর পথ’ ‘পাখির কলতান’ প্রভৃতি।
‘ইনার গেজ’ শিরোনামে নভেরা আহমেদের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট। প্রদর্শনীটি কেবল নভেরারই নয়, পাকিস্তানেই ছিল কোনো ভাস্করের প্রথম একক প্রদর্শনী। তাতে ভাস্কর্যের আধুনিক ধারায় নির্মিত ৭৫টি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছিল। এভাবেই নভেরা আহমেদ এ দেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। প্রদর্শনীর ৩০টি ভাস্কর্য পরে জাতীয় জাদুঘর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে।
তাঁর দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী হয় ব্যাংককে ১৯৭০ সালে। এখানে তিনি ধাতব পদার্থ ব্যবহার করে ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ১৯৭৩ সালে তাঁর তৃতীয় একক প্রদর্শনী হয় প্যারিসে। ২০১৪ সালে প্যারিসেই একশ দিনব্যাপী তার শেষ প্রদর্শনী হয় । কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নভেরা আহমেদ ১৯৯৭ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।
তাঁকে নিয়ে জীবনী উপন্যাস রচনা করেছেন প্রখ্যাত লেখক হাসনাত আবদুল হাই (নভেরা, ১৯৯৫)। এছাড়া তাঁকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মান করেন এন রাশেদ চৌধুরী। এছাড়া জাতীয় জাদুঘরের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল'।
প্যারিসপ্রবাসী নভেরা আহমেদ ২০১০ সাল থেকেই অসুস্থ ছিলেন। স্ট্রোকের কারণে শেষ কয়েকটা বছর তাঁকে ঠাঁই করে নিতে হয়েছিল হুইলচেয়ারে। এ ছাড়া শ্বাসকষ্টেও ভুগছিলেন তিনি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বয়সজনিত আরও নানা জটিলতায়। মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যেতে হতো তাঁকে। মৃত্যুর আগের দুই দিন ছিলেন কোমায়। ১১ মে প্যারিসেই পরিবারের সদস্যরা নভেরাকে অন্তিম শয্যায় শায়িত করবেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা নভেরার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
“মহান এই শিল্পীর প্রয়াণে জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো,” বুধবার এক শোক বাণিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
“পশ্চাদপদ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা বাধা অতিক্রম করে তিনি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর স্বাধীনচেতা স্বভাব তাঁকে সমুন্নত মস্তকে দাঁড় করিয়েছিল সকল বিপরীত স্রোতের সামনে,” বেনরাকে জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ।