বাবা মা হত্যার দায়ে ঐশীর মৃত্যুদন্ড, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.11.12
BD-oishee আদালতে মা-বাবা হত্যার দায়ে মৃত্যুদন্ডের রায় শোনার পর ঐশী। ১২ নভেম্বর, ২০১৫
বেনার নিউজ

সদ্য কৈশোর পার করা একটি মেয়ে। বাবা-মায়ের স্নেহের পরশে ভবিষ্যত সাজানোর কথা যার, সেই বাবা-মাকে খুনের দায়েই ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি এখন মেয়েটি। কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে কাটছে দিন তার।

বৃহস্পতিবার ঐশী রহমান নামে মেয়েটিকে পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মাহফুজুর রহমান ও মা স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

তবে অল্প বয়সী মেয়েটি সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া নিয়ে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা প্রশ্ন তুলেছেন- এই অপরাধের জন্য সে কি একাই দায়ী? পরিবার, সমাজ কোনভাবে তার অপরাধের দায় এড়াতে পারে না বলেও তারা মনে করেন।

এমনকি মামলা দায়েরকারী নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেলও আদালতকে বলেছিলেন, ভাতিজি ঐশী বাবা-মাকে খুন করতে পারে বলে তিনি মনে করেন না।

২০১৩ সালে পুলিশ দম্পতি হত্যাকাণ্ড এবং ওই ঘটনায় তাদের কিশোরী মেয়ের জড়িত থাকার অভিযোগ বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ওই ঘটনা বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোরদের বেড়ে ওঠা এবং তাতে অভিভাবকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের পর ঐশীকে আশ্রয় দেওয়ায় তার বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানার টাকা দিতে না পারলে তাকে আরও এক মাস বিনাশ্রম সাজা খাটতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন ঐশীর আরেক বন্ধু আসাদুজ্জামান জনি। তিন আসামির উপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা হয়।


‘পরিকল্পিতভাবেই খুন: আদালতের পর্যবেক্ষণ

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত জানায়, “ঐশী পরিকল্পিতভাবে, সময় নিয়ে তার বাবা মার হত্যাকাণ্ড ঘটায়। খুনের সময় সে সুস্থ স্বাভাবিক ছিল। সে মাদকাসক্ত হলেও বাবা-মাকে সে হত্যা করেছিল সুস্থ মস্তিষ্কে।”

এ কারণ দেখিয়ে বাবা ও মাকে হত্যার দুটি অভিযোগের দুটিতেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

হত্যাকাণ্ডের পর ‘অপরাধী’ ঐশীকে আশ্রয় দেওয়ায় তার বন্ধু রনিকে দুই বছরের সাজা হয়েছে। তবে গ্রেপ্তার হওয়ার পর রনি ইতোমধ্যে ১৯ মাস হাজতবাস করায় দুই বছরের সাজা থেকে ওই সময় বাদ যাওয়ার কথা রায়ে বলা আছে রলে জানান এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মাহবুবুর রহমান।

আর ঐশীর এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানান তার আইনজীবী  ফারুক আহম্মদ।


শিশু আদালতে চলছে গৃহকর্মীর বিচার

ঐশীকে সহযোগিতার অভিযোগে ঐশীদের বাসার শিশু গৃহকর্মী খাদিজা আক্তার সুমির বিচার চলছে শিশু আদালতে। ১১ বছরের সুমি তদন্ত চলাকালে হাকিম আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ড ও পরে লাশ সরানোর ক্ষেত্রে ঐশীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিয়েছিল। অপ্রাপ্ত বয়স্ক সুমির মামলার বিচারকাজ এখনও শেষ হয়নি। বর্তমানে গাজীপুরের কিশোর সংশোধন কেন্দ্র থেকে মা সালমা বেগমের জিম্মায় জামিনে রয়েছে সে।


বিচার প্রত্যাখ্যান

রায়ের পর এ বিষয়ে সমালোচনায় ফেটে পড়ে মানবাধিকার কর্মীরা। সামাজিক গণমাধ্যমেও চলছে রায়ের সমালোচনা। অনেকে ঐশীর ঐদ্ধত্যপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য তার পরিবার এবং সমাজকে দায়ী করেছেন।

তাসলিমা মিজি নামে একজন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, “পরিবার এবং সমাজের ভুল স্কুলিং এবং মাদকের অবাধ বানিজ্য নিয়ন্ত্রনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার শিকার কিশোরী ঐশীকে তার পিতা-মাতা হত্যার দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানোর যে রায় দিয়েছে আদালত, আমি রাষ্ট্রের একজন বিবেকবান নাগরিক হিসেবে তা প্রত্যাখ্যান করছি”।

তিনি আরো লিখেছেনঃ এ রায় অমানবিক, অসম, মানবতা বিবর্জিত এবং অনাধুনিক। এ রায় দেশের মাদক বাণিজ্য দমনে কোন ভুমিকা রাখবেনা, সন্তানকে সুশিক্ষা দিয়ে সুমানুষ হিসেবে বড় করার কোন তাগিদ তৈরি করবেনা। ভোগবাদী পিতাকে সন্তান মানুষ করার চেয়ে লুটপাট করে অনৈতিক অর্থ উপার্জনেই প্রনোদনা দেবে। এ হটকারী রায় এটুকুই প্রমান করেছে, দুর্বলের জন্য বিচারের বানী প্রকাশ্যে মায়া কান্না করছে। এই সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে ঐশীর মানবাধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত করতে আমার ব্যর্থতার জন্য করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী।

আর মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “ সদ্য কিশোর পার করা ঐশী কোন পেশাদার খুনী নয়। তাকে সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে তার পরিবার, এমনকি সমাজও। তাই সমাজ বা তার পরিবার কোনভাবেই এ হত্যার দায় এড়াতে পারে না। তাকে শোধরানোর সুযোগ দিতে হবে”।

তিনি আরো বলেন, “আমরা মনে করি এই রায়ের রিভিউ হওয়া প্রয়োজন। আশা করি উচ্চ আদালতে ঐশীর পারিবারিক, সামাজিক পরিস্থিতি বিচার করে তাকে সংশোধনের সুযোগ দেবে। এছাড়া এই ঘটনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা, মাদক নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিসহ সন্তানদের প্রতি পরিবারগুলোর দায়িত্বহীনতাকে আঙ্গল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আদালতের কাছ থেকে এসব বিষয়ে কিছু নির্দেশনাও আশা করেছিলাম আমরা”।


সেদিন যা ঘটেছিল

স্ত্রী, দুই সন্তান এবং শিশু গৃহকর্মীকে নিয়ে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে থাকতেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (রাজনৈতিক শাখা) পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান। ২০১৩ সালের ১৬ অগাস্ট ওই বাসা থেকেই তাদের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, আগের রাতে কোনো এক সময়ে কফির সঙ্গে ৬০টি ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেন ঐশী। পরদিন সকালে সাত বছর বয়সি ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে তিনি বেরিয়ে যান। পরে ভাইকে এক প্রতিবেশীর বাসায় পাঠিয়ে একদিন পর গৃহকর্মী সুমিকে নিয়ে রমনা থানায় আত্মসমর্পণ করেন এই কিশোরী।

রিমান্ডের পর ঐশী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেও পরে তা অস্বীকার করে বলেন, ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছিল। আদালতে তিনি দাবি করেন, বাবা-মা যখন খুন হন তখন তিনি বাসায় ছিলেন না; কারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাও তিনি জানেন না।

বয়স নিয়ে দ্বন্দ্ব

ঐশীকে রিমান্ডে নেওয়ার পর থেকে তার বয়স নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ঢাকার অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ‘ও’ লেভেলের এই শিক্ষার্থীর বয়স বিদ্যালয়ের নথি অনুযায়ী ১৮ বছরের কম হওয়ায় তাকে রিমান্ডে নেয়ার মাধ্যমে শিশু আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। বয়সের সমর্থনে খুলনার একটি ক্লিনিকের জন্মসনদও আদালতে দাখিল করেন ঐশীর আইনজীবী।

পরে আদালতের নির্দেশে গতবছর ঐশীকে পরীক্ষা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তার বয়স ১৯ বছরের মতো বলে জানান। রায়ে বিচারক বলেছেন, আসামিপক্ষ তাকে অপ্রাপ্তবয়স্ক বললেও তা প্রমাণ করতে পারেনি।


মামলা বৃত্তান্ত

২০১৪ সালের ৯ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মো. আবুল খায়ের মাতুব্বর আদালতে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। তাতে বলা হয়, বাবা-মা’কে ঐশীই হত্যা করেন; আর অন্যরা তাকে সহযোগিতা করেন।

মহানগর দায়রা জজ আদালত গত বছরের ৬ মে ঐশীসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করে। পরে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে গেলে গত বছরের ৩০ নভেম্বর ঢাকার তিন নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ বি এম সাজেদুর রহমান আবারও অভিযোগ গঠন করে ঐশীদের বিচার শুরু করেন।

বাদীপক্ষে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ঐশীর চাচাসহ ৩৯ জনের জবানবন্দি শোনে আদালত। রাষ্ট্রপক্ষে  বিশেষ প্রসিকিউটর মাহবুবুর রহমান এবং আসামিপক্ষে  ফারুক আহমেদ ও মাহবুবুর রহমান রানা গত ২০ অক্টোবর ও ৪ নভেম্বর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

এর আগে গত ১৩ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি ঐশীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হলে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন তিনি। অপর দুই আসামি জনি ও রনিও নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।