হাতে লেখা পাসপোর্ট নিয়ে বিপাকে ৫০ লাখ প্রবাসী, প্রথম ‘না’ করল ভারত
2015.08.31
প্রতিবেশী দেশ ভারত সবার আগে জানিয়ে দিল আজ ১ সেপ্টেম্বর থেকে ভিসার আবেদনের ক্ষেত্রে হাতে লেখা পাসপোর্ট গ্রহণ করবে না ভারতীয় হাইকমিশন। আগামী ২৪ নভেম্বরের পর থেকে পৃথিবীর কোথাও হাতে লেখা বাংলাদেশি পাসপোর্ট চলবে না।
সরকারের হিসাবে, এখনো অন্তত ৫০ লাখ প্রবাসীর হাতে মেশিনে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) পৌঁছাতে পারেনি সরকার। পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় এমআরপি নিয়ে সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (আইসিএও) বাংলাদেশকে এমআরপি চালুর নির্দেশনা দিয়েছিল ১৬ বছর আগে। কিন্তু বাংলাদেশ যথাযথ উদ্যোগ নিতে না পারায় এখন সংকট তৈরি হয়েছে।
বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এমআরপি প্রকল্প চালুর পর পাঁচ বছরে প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১ হাজার ১০০ প্রবাসীর হাতে এই পাসপোর্ট পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রকল্প চালুর পর ২০ লাখ প্রবাসী এমআরপি পেয়েছেন।
এই সময়ে আরও ২০ লাখ প্রবাসী দেশেই এমআরপি পেয়েছেন। মোট প্রবাসীর সংখ্যা ৯০ লাখ হওয়ায় এখনো ৫০ লাখ প্রবাসী এমআরপি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এখন পাসপোর্ট দেওয়ার যে ধীর গতি, তা অব্যাহত থাকলে অবশিষ্ট তিন মাসে এত মানুষকে এমআরপি দেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এদিকে কাজটি দ্রুত করার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ (আউটসোর্সিং) দিয়েছিল সরকার। তাতে উল্টো জটিলতা তৈরি হয়। সবচেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি হয় সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
“আগে কী হয়েছে, সেটা বড় কথা না। সামনে যে সময়টা আছে, সেই সময়ের মধ্যে কাজটা শেষ করতে চাই এবং সেটা পারব,” সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ।
এমআরপি দেওয়ার কাজ পেয়েছে মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠান আইরিস করপোরেশন। সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্র সচিব সহ সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানের কাজের ব্যাপারে বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমআরপি সমস্যা সমাধানে তাঁর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স এবং সাবেক প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে উপদেষ্টা কমিটি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই কমিটি বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও কাজে গতি আনেনি আইরিস।
কেন আইরিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে এমআরপি প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান সাংবাদিকদের বলেন, তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং বারবার সতর্ক করা হয়েছে।
কিন্তু এতোবার সতর্ক করা সত্তেও কোন রহস্যজনক কারণে আইরিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না তা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আইরিসকে সৌদি আরবে প্রতিদিন নয় হাজার এবং আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার করে এমআরপি দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা এখনো সৌদি আরবে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৯০০, আরব আমিরাতে ১২৫ এবং মালয়েশিয়ায় মাত্র ৭০টি এমআরপি দিতে পারছে।
এমন পরিস্থিতিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব প্রবাসী এমআরপি পাবেন না। এর ফলে বিদেশে হয়রানির শিকার হবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
এমআরপি না থাকায় বৈধ আকামা বা কাজের অনুমতিও পাসপোর্টে লাগাতে পারবেন না তাঁরা। এতে তাঁদের অবৈধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
“পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। সবাই তো আর একসঙ্গে ভ্রমণ করবেন না যে তাঁদের একসঙ্গে এমআরপি লাগবে,” বেনারকে জানান বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এন এম জিয়াউল আলম।
সংকটে মালয়েশিয়ার প্রবাসীরা
পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫০ লাখের বেশি প্রবাসী রয়েছেন। এ কারণেই সেখানে এমআরপির তথ্যসংগ্রহ, ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ ও ডিজিটাল স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজটি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত হয়।
এর মধ্যে মালয়েশিয়ার জন্য ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র ডাকা হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজটি পায় ডেটাএজ-আইপিপল কনসোর্টিয়াম। কিন্তু তারা কাজটি শুরুর পর মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার এমআরপি তৈরি করতে শুরু করে। কিন্তু আইরিস সেই কাজটি নেওয়ার পর এখন মাসে দুই হাজার এমআরপিও দিতে পারছে না।
ডেটাএজ-এর চেয়ারম্যান আহসান হাবিব অভিযোগ করেন, এমআরপি বই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইরিস চাপের মুখে তাঁদের কাজ নিয়ে নেয়। তবে আইরিস নিজের নামে না নিয়ে ‘বিতারা আবাদি’ নামে আরেকটি কোম্পানি খুলে মালয়েশিয়ায়। আবার বিতারা কাজটি দীপন ইনফো টেক নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে তারাও মালয়েশিয়ায় এমআরপির কাজ প্রায় বন্ধ করে দেয়।
এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ডাটাএজ ও আইরিসের দ্বন্দ্বে মালয়েশিয়ায় আউটসোর্সিং প্রায় বন্ধ। তাদের দ্বন্দ্ব না মেটায় এখন দূতাবাসের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায়ও জটিলতা
মালয়েশিয়ার মতোই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে আমিরাতে। সেখানে অবশ্য দরপত্রের মাধ্যমেই কাজ পেয়েছিল আইরিস করপোরেশন। কিন্তু নিজেরা কাজ না করে সেখানেও তারা দীপন ইনফো টেককে কাজ দেয়।
ওই প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ফির বদলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানি করছে বলে বারবার অভিযোগ ওঠে।
সরকারের হিসাবে, সেখানকার হাইকমিশন যেখানে প্রতিদিন সাড়ে সাত শ এমআরপি দিচ্ছে, সেখানে আইরিস দিচ্ছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। সমস্যা সমাধানে আইরিসকে সেখানে ১০০ ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র (মোবাইল ইউনিট) খোলার কথা বলা হয়। কিন্তু তারা সেই কাজটিও করতে পারেনি।
একই ঘটনা ঘটছে সৌদি আরবে। সেখানে আইরিস এক বছরে মাত্র ৪৪ হাজার ৬০০ পাসপোর্ট বিতরণ করে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। সেখানে আইরিসের স্থানীয় অংশীদার কোয়াদ টেলিকম, যাদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সমস্যা সমাধানে সেখানে ১২০টি ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র ও দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল দিতে বলা হয় আইরিসকে। এ ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রগতি নেই।
সবার আগে ভারতের ‘না’
ভিসার জন্য কেবল এমআরপি গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ।
গত রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, হাতে লেখা পাসপোর্ট বন্ধের লক্ষ্যে ভারতীয় ভিসার জন্য আবেদনকারীদের জানানো যাচ্ছে যে ১ সেপ্টেম্বর থেকে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া পরিচালিত বাংলাদেশের সব ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রে (আইভিআইসি) শুধু বাংলাদেশ সরকারের ইস্যু করা এমআরপি গ্রহণ করা হবে।