ভাবমুর্তি হারাচ্ছে পুলিশ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য অভিযোগ
2016.01.20
পুলিশ। আইনশঙ্খলা রক্ষাই যাদের দায়িত্ব। অথচ বাংলাদেশে এই পুলিশ বাহিনীই এখন আইন ভাঙা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নানাভাবে সমালোচিত হয়ে উঠছে। মাঠ পর্যায়ের কিছু সদস্যের অপেশাদার ও মানবাধিকার লঙ্ঘণমূলক কাজে বিব্রত পুরো পুলিশ প্রসাশন থেকে সরকার। উন্নয়ন সহযোগীরাও সহযোগিতা বন্ধের হুমকি দিচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে যখন তোলপাড় চলছে, তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই পুলিশ প্রশাসন কিছু কিছু অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের অপরাধকাণ্ড বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনারই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।
সম্প্রতিকালে আলোচিত পুলিশের অপরাধ কাণ্ড
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী গত শনিবার (৯ জানুয়ারি) রাতে রাতে নির্মমভাবে টহল পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত হন। মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদারসহ পুলিশ ও আনসারের পাঁচ সদস্য রাব্বীকে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এক সময়ে সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিয়েও ছাড় পায়নি সে।
সেদিন কোন রকমে প্রাণে বাঁচলেও নির্মম নির্যাতনের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না গোলাম রাব্বি। পুলিশ তাকে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন চালায় বলে সে ঘটনার পরদিন গণমাধ্যমকে জানায় রাব্বি, যিনি এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
রাব্বিকান্ডের পরেই রাজধানীর মীর হাজীরবাগ এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে পুলিশের বেধড়ক পেটানোর ঘটে। সেখানে সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ উক্তি করে ওই পুলিশ কর্মকর্তা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিকাশের গলা টিপে ধরে পুলিশ কর্মকর্তাটি বলেন, “মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ।”
তবে পুলিশের এ আইন লঙ্ঘণ রাজধানীর বাইরেও কম নয়। দেশের সকল প্রান্তের নিরীহ মানুষই পুলিশের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। জিম্মি করে অর্থ আদায়, খুন, ছিনতাই থেকে শুরু করে যৌন নির্যাতনের অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
তবে গণমাধ্যমে তোলপাড় তোলা ঘটনাগুলোর সঙ্গে জড়িতদের ক্লোজ করে কিংবা বদলির বা সাময়িক বহিষ্কারে সীমাবদ্ধ থাকছে পুলিশের শাস্তি।
এসব ঘটনার পরে সম্প্রতি পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, “কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশের অধিকাংশ সদস্যই আইনগতভাবে কাজ করে। তবে কেউ কেউ বিচ্যুত হলে তাদেরকে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয় না বাংলাদেশ পুলিশ। অপরাধী হিসেবে এদেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
তবে অপরাধের সঙ্গে সকল পুলিশ জড়িত নয়। সামান্য কয়েকজন পুলিশের অপরাধ কর্ম গোটা পুলিশ বাহিনীর সুনাম ক্ষুন্ন করছে এমন দাবি বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যের। সামান্য কয়েকজনের অপরাধে গোটা বাহিনীর উপর আস্থা হারানো ঠিক নয় মনে করেন তারা।
এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল জানান, মানুষ হিসেবে পুলিশেরও কিছু ভুল রয়েছে। তবে তাই বলে পুলিশের ওপর আস্থা হারানো ঠিক হবে না। কারণ, পুলিশের বহু সাফল্যের উদারহণও রয়েছে। আর দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বিকে নির্যাতন করার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ শিকদারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এভাবে অভিযোগ প্রমাণের ভিত্তিকে সকল দোষীর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বা হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘পুলিশে লোকবল অনেক। দু’একজন অপরাধ করতেই পারে। তবে পুলিশ যদি ন্যূনতম অপরাধও করে তা আমরা আমলে নিই। তাদের প্রতি কখনোই অনুকম্পা দেখানো হয় না।’
নির্ধারিত পোশাকেই পুলিশের দায়িত্ব পালনে জোর
পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা চাঁদাবাজিসহ বেশকিছু অভিযোগ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, এখন থেকে পুলিশকে দায়িত্ব পালনের সময় তাদের জন্য নির্ধারিত পোশাক পরতে হবে। আর কোন পুলিশ সদস্য সাদা পোশাকে ডিউটি করতে পারবে না। তবে গোয়েন্দা পুলিশ যদি সাধারণ পোশাকে দায়িত্ব পালন করেন, তবে অবশ্যই তাকে গোয়েন্দা পুলিশের ট্যাগ মার্ক লাগানো কোট পরতে হবে। শিগগিরই এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করা হবে।
‘বিচারের অভাবেই বাড়ছে পুলিশের দৌরাত্ম’
তবে রাজনৈতিক ব্যবহার, বিচারহীনতা ও অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই পুলিশের অপরাধ করার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে মন্তব্য মানবাধিকার কর্মীদের।
এ বিষয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (তদন্ত) নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “রাজনৈতিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেশি ব্যবহারের ফলেই তাদের মাঝে এই হামবড়া স্বভাব দেখা গেছে। এছাড়া এসব বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির নানা অনিয়ম তাদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন, “সাধারণ মানুষ অন্যায় করলে তাদেরকে ধরে শাস্তি দেওয়ার জন্যই পুলিশ বাহিনী গঠন। কিন্তু পুলিশ বাহিনী অন্যায় করলে আইনের আশ্রয় কে নেবে। বিগত দিনগুলো পুলিশ অনেক অন্যায় করেছে, তাদেরকে বিচারের আওতায় না আনার ফলেই এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। আগে কিছুটা রাখঢাক করে অন্যায় করলেও পুলিশ এখন অপরাধ করছে প্রকাশ্যে।”
তিনি বলেন, “পুলিশ যখন বেপরোয়া হয়ে উঠে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যখন আইন লঙ্ঘণ করে, আ্ইনের শাসন মানেনা, তখন দেশের নিরাপত্তা বড় ঝুঁকির মধ্যে থাকে।”
এই মানবাধিকার কর্মীর মতে, নিজ বাহিনীর ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে পুলিশ বাহিনীরই উচিত দোষীদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। যাতে আর কোন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আইন লঙ্ঘণ করার সাহস না পায়।
এক বছরে প্রায় ১০ হাজার পুলিশ সদস্যের শাস্তি
তবে পুলিশও অপরাধের দায়ে শাস্তি পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত এক বছরে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মোট ৯ হাজার ৯৫৮ পুলিশ সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৬ পুলিশ সদস্য সরাসরি ফৌজদারি অপরাধের আসামি। চাকুরিচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি আদালতে তাদের বিচার চলছে। এদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) ৭০ জন, উপপরিদর্শক (এসআই) ৪ জন এবং পরিদর্শক ২ জন।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল এই ৫ বছরে কনস্টেবল থেকে ৬৭ হাজার ৮২০জন পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো দেওয়া হয়।
এবিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার এআইজি নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ সদস্যরা সমাজের বাইরের কেউ নয়। সমাজে অপরাধ যেমন বাড়ছে, তার প্রতিফলন কিছুটা এই বাহিনীর ভেতরেও দেখা যাচ্ছে। তবে পুলিশ বাহিনী সেসব অপরাধের কারণ খুঁজে বের করে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।’
বন্ধ হতে পারে দাতা গোষ্ঠীর সহযোগিতা
এদিকে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন দেশ সহযোগিতা করে থাকে। তবে তাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) বিরুদ্ধে অপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘণের ঘটনায় সেসব বন্ধ হওয়ার আভাস পোওয়া গেছে।
বুধবার প্রথমবারের মত সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ঢাকায় নবনিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেইক এ প্রসঙ্গে বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে, তাতে যুক্তরাজ্য উদ্বিগ্ন।
এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের সহযোগিতা রয়েছে। তবে কারও বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা কারও কাজের প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন থাকলে ব্রিটিশ সরকার তাদের সহযোগিতা করবে না।
এছাড়া এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা প্রত্যেকটি অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।