রাজন হত্যাকান্ডে অবহেলার অভিযোগে তিন পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত
2015.07.27
বাংলাদেশের সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন(১৪) হত্যার ঘটনায় গাফিলতি ও আসামিদের পালিয়ে যেতে সহায়তার অভিযোগ উঠার পর পুলিশের এক পরিদর্শকসহ তিন সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এদের মধ্যে জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির হোসেন ও এসআই আমিনুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রহমত উল্লাহ।
সোমবার সন্ধ্যায় তিনি বেনারকে জানান, “রাজন হত্যা পরবর্তী সময়ে মামলা দায়েরে বিলম্ব এবং প্রধান আসামি কামরুলের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশি গাফিলতি খতিয়ে দেখতে এসএমপি (সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ) গঠিত তদন্ত কমিটি গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিবেদন দাখিল করে। পরের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় এসএমপির জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেনকে প্রত্যাহার এবং উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির হোসেন ও আমিনুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ সময় এসএমপি কমিশনার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই সোমবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।”
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কামরুল আহসান বলেন, “গাফিলতি, কর্তব্য অবহেলা ও অসদাচরণের অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
এদিকে সিলেট সফর গিয়ে গত শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “রাজন হত্যায় পুলিশের ভূমিকা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে।”
তিন দিনের সফরে সিলেট গিয়ে গত বুধবার রাজনের বাড়িতে গিয়ে তার বাবা-মাকে সান্ত্বনা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার সফরের মধ্যেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়ে।
শিশু রাজন হত্যার ঘটনায় তার বাবা শেখ আজিজুর রহমান পুলিশের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ তুললে তা খতিয়ে দেখতে ১৪ জুলাই সিলেট মহানগর পুলিশ তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তিন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো। ২৩ জুলাই রাতে ৪২৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন সিলেটের পুলিশ কমিশনারের কাছে দাখিল করা হয়। ওই প্রতিবেদনে পুলিশের গাফিলতির বিষয়টি নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়।
গত ৮ জুলাই সিলেটের কুমারগাঁওয়ে চুরির অভিযোগ তুলে শিশু রাজনকে পিটিয়ে হত্যা করে কয়েকজন। ওই নির্যাতনের দৃশ্য ভিডিও করে তারা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিলে সারা দেশে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর আসামি মুহিতকে বাঁচাতে এবং তার সৌদিপ্রবাসী ভাই কামরুলকে পালিয়ে যেতে সিলেটের জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর হোসেন ও এসআই আমিনুল ইসলাম সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ করেন রাজনের বাবা। এছাড়া দায়িত্বে অবহেলা এবং থানায় মামলা করতে গেলে রাজনের বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহারেরও অভিযোগ ওঠে পুলিশে এই দুই সদস্যের বিরুদ্ধে।
সিলেট মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, ঘটনার মূল হোতা কামরুল ইসলামের দেশ ছেড়ে পালানোর ক্ষেত্রে দুই এসআই আমিনুল ও জাকিরের গাফিলতির প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। ঘটনার দিন জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন চট্টগ্রামে একটি মামলার সাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন।
ওই সময় ওসির দায়িত্বে ছিলেন পরিদর্শক আলমগীর হোসেন। তদন্তে দুই এসআইয়ের সঙ্গে পরিদর্শক আলমগীরের যোগসূত্রের প্রমাণও মিলেছে। ওই তিন কর্মকর্তার মুঠোফোনের চার দিনের (৮ জুলাই থেকে ১২ জুলাই) কললিস্ট সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে আসামিপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ও ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করার অভিযোগ ওঠা রাজনীতিকদের কললিস্টও রয়েছে।
রাজন হত্যার ঘটনায় আসামি মুহিত আলম, তার স্ত্রী লিপি বেগম, দুই প্রত্যক্ষদর্শী আজমত উল্লাহ ও ফিরোজ আলীসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যাদের মধ্যে সাতজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
অন্যতম আরেক আসামি কামরুল ইসলাম দেশ ছেড়ে সৌদি আরবে পালিয়ে গেলে সেখানকার প্রবাসীরা তাকে আটক করে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
এসব পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রাজনের বাবা আজিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমার শিশু সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে কামরুল মুহিতসহ অন্যরা। জনগণের সাহায্যে আসামিদের ধরা হলেও মূল আসামি কামরুলকে এখনো দেশে আনা হয়নি। সেদিন পুলিশরাও নিজেদের দায়িত্বে অবহেলা এবং আসামি পালাতে সহায়তা করার মাধ্যমে সমান অপরাধ করেছে। তাদেরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে শুনেছি। কিন্তু এটা যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি তাদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়াটা জরুরি। তবে আমি আইনের উপর আস্থা রাখি। আশা করি, দেশের আইন তাদেরকে উপযুক্ত সাজা দেবে।”
তিনি আরো বলেন, “এসব অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে যাতে আর কোন পিতা-মাতার কোল খালি না হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যূনালে আমি রাজন হত্যার বিচার চাই।”
এ বিষয়ে ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটসের মহাসচিব অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা রাজন হত্যার বিচারের আনুষঙ্গিক কাজ। এটা ন্যায় বিচারের জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাই তাদেরকে পুলিশের নিরপেক্ষ বিভাগীয় বিচারের আওতায় আনতে হবে। একইসঙ্গে তারা শুধু বিভাগীয় অপরাধ করেনি। মামলা না নিয়ে, আসামিকে পালাতে সাহায্য করে তারা মূল অপরাধের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। সে কারণে এইসব পুলিশ অফিসারদের হত্যা-মামলার অপরাধেও বিচার হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।”
“একইসঙ্গে মূল আসামিকে বিদেশ থেকে ফেরত আনা, দ্রুত এবং সঠিকভাবে ময়না তদন্ত রিপোর্ট দেওয়া, আসল সাক্ষীদের মামলায় শেষ পর্যন্ত হাজির করানোসহ মামলার সকল প্রক্রিয় সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। তবেই ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে”- যোগ করেন তাজুল ইসলাম।