ছাত্র নির্যাতনের ঘটনায় ওসি হেলালের সাজা বহাল
2016.07.27
ঢাকার খিলগাঁও থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিনের সাজা বহাল রেখেছেন আদালত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদেরকে নির্যাতনের মামলায় তাঁর তিন বছর কারাদণ্ড হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে তাঁর করা আপিল খারিজ করেছেন বিচারক।
গতকাল বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের (সিএমএম) দেওয়া কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে ওসি হেলালের আপিল শুনানি শেষে ঢাকার পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জাহিদুল কবির এই রায় দেন।
কাদেরের আইনজীবী মুনজুর আলম বেনারকে বলেন, “হাকিম আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে গত বছরের জুন মাসে আপিল করেছিলেন ওসি হেলাল। শুনানি শেষে আদালত তার ওই আপিল খারিজ করে দিয়েছেন। এতে ওসি হেলালের দণ্ড বহাল রইল।”
গত বছরের ১৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র আবদুল কাদেরকে নির্যাতন ও জোর করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টার দায়ে হেলাল উদ্দিনকে ওই দণ্ডাদেশ দেয় আদালত।
পাশাপাশি তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
বর্তমানে হাইকোর্ট থেকে জামিনে থাকা হেলাল সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় পুলিশের ঢাকা রেঞ্জে সংযুক্ত আছেন। আবদুল কাদের এখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রভাষক।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৬ জুলাই খালার বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ফেরার পথে সেগুন বাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যালয়ের সামনে সাদা পোশাকের পুলিশ কাদেরকে আটক করে। কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় খিলগাঁও থানায়।
ওই থানার তখনকার ওসি হেলাল কাদেরের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য মারধর করে। একপর্যায়ে থানার টেবিলে রাখা একটি চাপাতি নিয়ে ‘দেখি তো চাপাতিতে ধার আছে কি না’ বলে কাদেরের বাঁ পায়ের পেছন দিকে মাংস পেশিতে আঘাত করে।
গুরুতর আহত কাদেরকে এরপর দীর্ঘদিন হাসপাতালে কাটাতে হয়। এরই মধ্যে ২১ জুলাই তাঁকে মোহাম্মদপুর থানার একটি গাড়ি ছিনতাই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে খিলগাঁও থানার অস্ত্র ও ডাকাতি চেষ্টার দুটি মামলায় আসামি করা হয়, যদিও এসব মামলার এজাহারে কাদেরের নাম ছিল না।
আবদুল কাদেরকে নির্যাতনের একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন ওই থানার কনস্টেবল আবদুল করিম। হাকিম আদালতে জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, ঘটনার দিন তিনি রাত ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত ডিউটিতে ছিলেন। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এসআই আলম বাদশা কাদেরকে আটক করে থানায় নিয়ে যান। ডিউটি অফিসার মো. আসলামের নির্দেশে তাঁকে হাজতে আটক রাখা হয়।
পরদিন থানায় এসে ওসি হেলাল লকার খুলে কাদেরকে তার কক্ষে নিয়ে যেতে বলেন। ওসি হেলালের কক্ষে রেখে এসে কনস্টেবল করিম কিছুক্ষণ পর কাদেরের চিৎকার শুনতে পান এবং গিয়ে দেখেন, ওই শিক্ষার্থী রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন; তাঁর বাঁ পা রক্তাক্ত।
মামলার অপর সাক্ষী খিলগাঁও থানার তখনকার ডিউটি অফিসার এসআই আসলাম মিয়াও আদালতে জবানবন্দিতে একই কথা বলেন।
কাদেরের ওপর পুলিশি নির্যাতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিষয়টি গণমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচিত হয়। এরপর হাই কোর্টের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি করে পুলিশ।
পুলিশি নির্যাতনের স্বীকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র কাদের। ফাইল ফটো, বেনার নিউজ।
এ বিষয়ে তদন্তের মধ্যেই হাই কোর্টের নির্দেশে খিলগাঁও থানার তখনকার ওসি হেলালউদ্দিন এবং কাদেরকে গ্রেপ্তারের অভিযানে যাওয়া এসআই আলম বাদশাহ ও এএসআই শহীদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পুলিশের তদন্তে তিন মামলাতেই নির্দোষ প্রমাণিত হন কাদের। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১২ সালের ২৩ জানুয়ারি তিনি ওসি হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই বছর ২৬ মার্চ আসামি হেলালের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. আবু সাঈদ আকন্দ।
২০১২ সালের ১ অক্টোবর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে হাকিম আদালতে এ মামলার বিচার শুরু হয়। ১৩ জনের সাক্ষ্য শুনে হাকিম তিন বছরের সাজার রায় ঘোষণা করেন।
আপিল খারিজ হওয়ার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে কাদের বেনারকে বলেন, “হেলাল আপিল করার পূর্বে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য যতভাবে চাপ প্রয়োগ করা সম্ভব তা করেছে। আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের দিয়ে সমঝোতার প্রস্তাব দেন, এমনকি আমার কলেজের অনেক সহকর্মীর মাধ্যমেও তিনি যোগাযোগ করেন।”
“সবশেষে তিনি টাকা দিয়ে বিষয়টি মিটমাট করারও প্রস্তাব দেন। কিন্তু আমি ন্যায়বিচার চাই। তাই কোনো প্রস্তাবে সাড়া দেইনি,” জানান কাদের।
তবে কাদের বলেন, “ওসি হেলালের মতো পুলিশ কর্মকর্তাদের যেন পুলিশ বাহিনীতে জায়গা না হয়। এমন দৃষ্টান্ত থাকা দরকার।”
নির্যাতিত ওই তরুণ বলেন, “গণমাধ্যমের সহায়তার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো আমার শঙ্কা কাটেনি। কারণ সাজা মওকুফের জন্য আসামি অবশ্যই উচ্চ আদালতে যাবে। সামনে আরও অনেক পথ। তাই খুব শঙ্কায় আছি।”