বিএনপির সঙ্গে থাকা না থাকা নিয়ে রাজনীতিতে চলছে ভাঙ্গাগড়া
2016.01.07
দেশের রাজনীতিতে এখন ভাঙাগড়ার রাজনীতি চলছে, এর মূল লক্ষ্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে ফাটল ধরানো। জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে।
জোটের আরেক বড় শরিক ইসলামি ঐক্যজোট গতকাল ঘোষণা দিয়ে জোট ছেড়েছে, যদিও ওই সংগঠনের একটি ছোট অংশ জোটে থেকে যাওয়ার পাল্টা ঘোষণা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জোটের ত্রি-বার্ষিকী সম্মেলনে ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন ।
অবশ্য পাল্টা ঘোষণা দিয়ে ইসলামি ঐক্যজোটের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রকিব বলেছেন, তাদের দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেই রয়েছে।
গত ৫ জানুয়ারি নয়া পল্টনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সমাবেশে জোটের শরিক নেতাদের অনুপস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনার মধ্যেই ইসলামি ঐক্যজোটের এ ঘোষণা এল।
এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে বিএনপি জোটে ভাঙন ধরিয়ে বেরিয়ে যায় শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)।
ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-এনডিএফ নামে নতুন ১০ দলের নতুন এক জোটের ঘোষণা দিয়ে নীলু সে সময় অভিযোগ করেছিলেন, ২০ দলের জোটে বিএনপি-জামায়াত সব সিদ্ধান্ত ‘চাপিয়ে দিত’।
৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিএনপির সমাবেশে ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর উপস্থিতি দেখা যায়নি। অনেক দিন পর রাজধানীতে বিএনপির বড় ধরনের এ কর্মসূচিতে শরিকদের কারও না থাকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
সমাবেশের পর কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে, জোটের অন্যতম দুই শরিক দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি ঐক্যজোট থেকে আপাতত দূরত্ব বজায় রাখতে ওই কর্মসূচি এককভাবে করার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। এ কারণে শরিকদের অন্য কাউকেও সমাবেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘একতরফা’ সংসদ নির্বাচন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট একসঙ্গে বর্জন করেছিল। এরপর নির্বাচন ঠেকাতে অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিও পালন করেছিল জোটবদ্ধভাবে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময়ে এবং পরবর্তী সময়ে ৫ জানুয়ারির প্রথম বর্ষপূর্তিকে ঘিরে জোটের কর্মসূচিতে জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা ছিল, যখন প্রায় তিন মাসের সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।
“সমাবেশটি ছিল বিএনপির একক কর্মসূচি। সেখানে শরিকদের দাওয়াত করার কথা নয়,” সমাবেশে জোটের কারও না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বেনারকে বলেন বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক শামীমুর রহমান।
৫ জানুয়ারির পর গতকাল ৭ জানুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সম্মেলন করে বিএনপি জোটের শরিক ইসলামি ঐক্যজোট। ওই সম্মেলনেও বিএনপির কাউকে দাওয়াত করা হয়নি। শরিক দলগুলোর ইফতার ও জাতীয় সম্মেলনসহ বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে সাধারণত বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা অতিথি হিসেবে থাকেন।
স্বতন্ত্র রাজনীতি করতে চায় ইসলামি ঐক্যজোট
সম্মেলনে লতিফ নেজামী বলেন, “ইসলামি ঐক্যজোট এখন থেকে স্বতন্ত্রভাবে রাজনীতি করবে। সে জন্য আমরা ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমরা আর জোটে নেই।”
ওই সম্মেলনে নেজামীকে চেয়ারম্যান ও মুফতি মুহাম্মদ ফয়েজুল্লাহকে জোটের মহাসচিব পদে পুনর্নির্বাচিত করা হয়।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘ওলামাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া’ জরুরি হয়ে উঠেছে মন্তব্য করে নেজামী বলেন, ইসলামি ঐক্যজোট এখন ‘স্বকীয়তা ধরে রেখে’ সাংগঠনিক তৎপরতায় আরও মনোযোগী হবে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নেবে।
আরেকাংশ জোটে থাকবে
আবদুল লতিফ নেজামী ২০ দল ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও ইসলামি ঐক্যজোটের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মাওলানা আবদুর রকিবের নেতৃত্বে আলাদা কমিটি করে বিএনপি জোটে থাকার প্রক্রিয়া চলছে।
দলের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে বলেন, “জোট ভাঙার এই ষড়যন্ত্র সফল হবে না।… আন্দোলনের জন্য বিএনপিই যথেষ্ট।”
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ইসলামি ঐক্যজোটের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে দলের চেয়ারম্যান লতিফ নেজামী ২০ দল ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে পাল্টা ঘোষণা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন মাওলানা রকিব ।
রকিব বলেন, “সম্প্রতি আমাদের ইসলামি ঐক্যজোটের কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি জোটের আদর্শ ও নীতি পরিপন্থী পদক্ষেপ নেওয়ায় এর মূল অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ নেজামে ইসলামি পার্টির নির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করা হয়।
“গতকাল (বুধবার) বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ওই সভায় আবদুল লতিফ নেজামীর পরিচালনায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, আমরা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলে থাকব ।”
ওই সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সব কাউন্সিলর ও জেলার প্রতিনিধি, পীর মাশায়েখ ও উলামায়ে কেরামদের মতামত অগ্রাহ্য করেই লতিফ নেজামী জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন বলে দাবি রকিবের।
কোন ক্ষমতাবলে আপনি চেয়ারম্যান হলেন- এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “জোটের সংবিধানে আছে চেয়ারম্যান যদি আদর্শ পরিপন্থি কিছু করেন, তাহলে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানই পদাধিকার বলে চেয়ারম্যান হবেন।”
জোটে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চলছে:বিএনপি
বিএনপি নেতারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, সরকার ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ধরানোর জন্য ‘বিভিন্নভাবে’ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তবে গতকাল বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, “শুধু ২০-দলীয় জোট থেকে নয়, বিএনপি থেকেও অনেক নেতা-কর্মী বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন ।”
তিনি দাবি করেন, বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর দলটির নেতা-কর্মীদের অনীহা ও আস্থাহীনতাও সৃষ্টি হয়েছে।
আবদুল লতিফ নেজামীর নেতৃত্বাধীন ইসলামি ঐক্যজোটের ২০-দলীয় জোট ছাড়ার ঘোষণার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মাহবুব উল আলম বলেন, ‘ইসলামি ঐক্যজোট কী কারণে জোট ছেড়েছে, সেটা এই মুহূর্তে আমরা সঠিকভাবে বলতে পারি না। তবে আজ শুধু জোট নয়, বিএনপির অনেক নেতাই সন্ত্রাসী ও অনৈতিক কাজের জন্য দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন।”
জোটের অতীত থেকে বর্তমান
১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগকে সরকার থেকে হঠাতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযম এবং ইসলামি ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
পরে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়। এখন জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে সরকারের মন্ত্রিসভায় এবং সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর পার্টি প্রধান এইচএম এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত।
তবে সেই থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির সঙ্গেই ছিল ইসলামি ঐক্যজোট। ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট থেকে নির্বাচন করে জাতীয় সংসদে দুটি আসনও পেয়েছিল তারা।
ফজলুল হক আমিনীর মৃত্যুর পর ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান হন আবদুল লতিফ নেজামী। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চারদলীয় জোট কলেবর বেড়ে ১৮ দলীয় যে জোট হলে ইসলামি ঐক্যজোটও সঙ্গে থাকে।
বিএনপি ও ইসলামি ঐক্যজোট ছাড়া সে সময় জোটের বাকি শরিকেরা ছিল জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ।
পরে পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল এই জোটে যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়।
তবে সরকারের চাপে বিরোধী ওই জোটও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। অনেক দিন ধরেই জোটের কর্মসূচি নেই। প্রায় দুই বছর পর জোটের প্রধান দল বিএনপি ৫ জানুয়ারি সমাবেশ করলেও সেখানে জোটের কাউকে ডাকা হয়নি।
“বস্তুত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির পর থেকে জোটবদ্ধ কর্মসূচি নেই। তার অর্থ এই নয় যে, ভবিষ্যতে জোটবদ্ধ কর্মসূচি থাকবে না,” জানান দলের যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।