জাতীয় পার্টিতে আবার নাটক, বিরোধী শিবিরে চলছে ভাঙাগড়া
2016.01.19
একমাত্র সরকারি দল আওয়ামী লীগ নিরাপদে আছে। কিন্তু স্বস্তিতে নেই দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলো। গণতন্ত্র না থাকায় এই বিশেষ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, সাধারণত জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখেই দল বা জোটে টানাপোড়েন হয়। এখন সেই সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে।
তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোতে এখন এই অস্থিরতা কেন?—এর জবাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি নানাভাবে সক্রিয় হচ্ছে। রাজনীতিতে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা গৌণ হওয়ায় এখন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি নেই। এর ফলে বিভিন্ন দল বা জোটে নানা ধরনের হস্তক্ষেপ হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বাইরে ‘আসল বিএনপি’ নামে একটি অংশ তৈরির চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কথিত ওই সংগঠনটি ইতিমধ্যে কয়েকবার বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল করতে গেলে মারামারি হয়েছে।
বিএনপির বিপক্ষে রাস্তায় নেমেছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, যিনি বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। বিতর্কিত ওই নেতা বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, আবার তাঁকে দলে নেওয়া হয়েছে। এরপর দল ছেড়ে গিয়ে নতুন দল ও জোট করেছেন। কিন্তু এসব উদ্যোগ সফল হয়নি। এখন তিনি সরকারি জোটের শরিক হতে চান, এ জন্য বিএনপিকে ঘায়েল করার পথ বেছে নিয়েছেন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, রাজনীতিতে বিরোধী দল বিএনপি, ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি ঐক্যজোট এখন নানামুখী চাপের মুখে। অন্যদিকে বাম সংগঠনগুলোর মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সরকারে আছে। সিপিবিসহ বাকি দলগুলো ক্রমাগত দুর্বল হচ্ছে।
“এখন যে রাজনীতি হচ্ছে তা ক্ষমতার হিসাব–নিকাশ মেলানোর রাজনীতি। এর সঙ্গে নীতি ও আদর্শের কোনো সম্পর্ক নেই,” বেনারকে জানান সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
জাতীয় পার্টি ভাঙনের মুখে
পাল্টাপাল্টি ঘোষণায় জাতীয় পার্টিতে (জাপা) সৃষ্ট ঝড় নতুন মোড় নিয়েছে। ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত চারবার ভেঙেছে জাতীয় পার্টি। আগামী মার্চে জাতীয় পার্টির ত্রিবার্ষিক সম্মেলন সামনে রেখে যখন নেতা কর্মীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তখনই আবার নতুন সংকটে পড়ল দলটি।
জাতীয় সংসদে একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকা ওই দলটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। দলের একপ্রান্তে আছেন এরশাদ, অপর প্রান্তে তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ। এই দুজনকে ঘিরে দলের নেতা–কর্মীরা বিরোধে জড়াচ্ছেন। রওশন এরশাদ বিরোধী দলের নেত্রী, এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত।
সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, এই দুজনকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলছে সরকার।
গত কয়েক বছরে নানা নাটকীয়তার জন্ম দেওয়া সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ গত রোববার তাঁর ভাই জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ও উত্তরসূরি ঘোষণা করেন।
এরপর সোমবার রাতে ঢাকায় পার্টির সরকার সমর্থক সাংসদ ও সভাপতিমণ্ডলীর নেতাদের একাংশের সভায় এরশাদের স্ত্রী বিরোধী দলীয় নেতা রওশনকে দলের ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন’ করা হয়।
মঙ্গলবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সংবাদ সম্মেলন করে জিয়াউদ্দিন বাবলুর পরিবর্তে রুহুল আমিন হাওলাদারকে দলের মহাসচিব ঘোষণা করেন।
আবার মঙ্গলবার বিকেলেই বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের কক্ষে বিকেল পৌনে চারটায় জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠক শুরু হয়। দলের বেশির ভাগ সাংসদই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
এইচ এম এরশাদ বৈঠক চলাকালে সাড়ে চারটার দিকে রুহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে বৈঠক ছেড়ে একতলা নিচে নিজের কক্ষে চলে যান। তারও আধঘণ্টা পরে বৈঠক শেষ হয়।
এরপর সংসদ ভবনের প্রধান গেটে অপেক্ষারত সাংবাদিকদের চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বৈঠকে জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। গত কয়েক দিনে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে তার সঙ্গে দলের কোনো সাংসদই একমত হতে পারেনি। দলের চেয়ারম্যানকে এসব সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে।
তাজুল বলেন, “জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যানের নাম ঘোষণা, মহাসচিব পদে নতুন একজনকে দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে। অধিকাংশ সাংসদ জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব হিসেবে রাখার দাবি করেছেন।”
তাজুল ইসলামের কথা বলার সময় সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবুল, মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুসহ আরও বেশ কয়েকজন সাংসদ উপস্থিত ছিলেন।
তাজুল ইসলামের ব্রিফিংয়ের পর সাংসদ শওকত চৌধুরীসহ আরও কয়েকজন এরশাদের কক্ষের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে যা আলোচনা হয়েছে তাজুল ইসলাম তার উল্টোটা বলেছেন।
এ সময় এরশাদ বলেন, “আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে অটল আছি। মরার আগ পর্যন্ত অটল থাকব।”
এরশাদ-রওশনের পাল্টাপাল্টি ঘোষণায় কার্যত দুই বলয়ে ভাগ হয়ে পড়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলের নেতারা জানান, রওশন বলয়ের নেতারা সরকারের সঙ্গে থাকতে আগ্রহী। এই দলে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদের সংখ্যাই বেশি। আর এরশাদ বলয়ে আছেন ক্ষমতা ও সরকারি সুযোগ-সুবিধার বাইরে থাকা অংশটি।
দলের ৪০ জন সাংসদের অধিকাংশই রওশন এরশাদের সঙ্গে আছেন। আর সংসদের বাইরে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের অধিকাংশই আছেন এরশাদের সঙ্গে।
তবে সরকারের নীতি নির্ধারণী একজন নেতা এ প্রসঙ্গে বেনারকে জানান, জাতীয় পার্টিতে রওশন এরশাদের কর্তৃত্ব হাতছাড়া হতে দেবে না সরকার। তবে দুই অংশের এই টানাপোড়েনে জাতীয় পার্টি ভেঙে যাক—এটাও সরকার চায় না।
বিএনপি ভাঙা নিয়ে বাহাস
সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতারা বলে আসছেন, বিএনপি বা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ভাঙার সঙ্গে সরকারের কোনোরকম সম্পর্ক নেই। বিএনপি থেকে কিছু নেতা বের হয়ে যাবে বলে রাজনীতিতে যেমন আলোচনা আছে, তেমনি সরকারি দলের একাধিক নেতা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এমন সম্ভাবনার কথা প্রকাশ্যে বলে আসছেন।
“আমি বিএনপি ভেঙে যাওয়ার কোনোরকম লক্ষণ বা সম্ভাবনা দেখি না। এর কারণও নেই,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ।
সাবেক ওই শ্রমিক নেতা মনে করেন, দেশে এখন গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্র ফিরে আসলে অনেক কিছুই ঠিক হয়ে যেত। এটা যতদিন না ফিরবে ততদিন সরকারি দলের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে বলে মত দেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে আলোচিত বিষয় হচ্ছে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ফাটল ধরানোর প্রসঙ্গ। জোটের প্রধান শরিক জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। এই জোটের আরেক বড় শরিক ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ নেজামী গত ৭ জানুয়ারি জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন। পাল্টা ঘোষণা দিয়ে ইসলামি ঐক্যজোটের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রকিব বলেছেন, তাদের দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটেই রয়েছে।
এর আগে ৫ জানুয়ারি নয়া পল্টনে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সমাবেশে জোটের শরিক নেতারা উপস্থিত ছিলেন না। জোটের অন্যতম দুই শরিক দল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি ঐক্যজোট থেকে আপাতত দূরত্ব বজায় রাখতে ওই কর্মসূচি এককভাবে করার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা।
তবে দীর্ঘদিন পর রাজধানীতে বিএনপির বড় ধরনের এ কর্মসূচিতে শরিকদের কারও না থাকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। অবশ্য বিএনপিও বলেছে, সমাবেশটি বিএনপির একক কর্মসূচি হওয়ায় সেখানে শরিকদের দাওয়াত করার কথা নয়।
এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে বিএনপি জোটে ভাঙন ধরিয়ে বেরিয়ে যায় শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-এনডিএফ নামে নামসর্বস্ব ১০ দলের নতুন এক জোটের ঘোষণা দেন তিনি।
বিএনপি নেতারা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, সরকার ২০ দলীয় জোটে ভাঙন ধরানোর জন্য ‘বিভিন্নভাবে’ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলে আসছেন, শুধু ২০-দলীয় জোট থেকে নয়, বিএনপি থেকেও অনেক নেতা-কর্মী বেরিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের ওপর দলটির নেতা-কর্মীদের অনীহা ও আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র নির্বাসিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
“বাংলাদেশ এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র উত্তরণের জন্য আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি,” সাংবাদিকদের বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৮০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর কবরে ফুল দেওয়া শেষে তিনি এ কথা বলেন।
“রাজনীতির যখন কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে না, তখন এখনকার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হচ্ছে গণতন্ত্রে ফেরা,” বেনারকে জানান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী।