জনপ্রশাসনে গণপদোন্নতি, পদের চেয়ে কর্তা বেড়ে গেলো দ্বিগুণ
2015.04.08
সরকার ৮৭৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ায় জনপ্রশাসনে এখন কর্মকর্তার সংখ্যা বিদ্যমান পদসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। এই ‘গণপদোন্নতি’ নিয়ে জনপ্রশাসনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
গত ৬ এপ্রিল সর্বশেষ এই পদোন্নতির ফলে এখন জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের ১০৭ পদে কর্মকর্তা ৩৭৩ জন, যুগ্ম সচিবের ৪৩০ পদে ৮৬৯ জন এবং উপসচিবের ৮৩০ পদে কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮১৮ জন।
বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, যোগ্য থাকার পরও তাঁদের পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ করা হয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয় দিয়েও অনেককে বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে।
“পদ ছাড়া কোনোভাবেই পদোন্নতি দেওয়া ঠিক নয়। আর পদোন্নতিতে যদি দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি হয়ে থাকে তা দুঃখজনক,” বেনারকে জানান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা আদেশে ৮৭৩ জন কর্মকর্তার মধ্যে অতিরিক্ত সচিব পদে ২৩১ জন, যুগ্ম সচিব পদে ২৯৯ জন এবং উপসচিব পদে ৩৪৩ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পান।
এর আগে বর্তমান সরকারের গত ছয় বছরে কয়েকদফায় প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ফলে উপসচিব থেকে উপরের পদগুলোতে আর শূন্য পদ নেই। পদের চেয়ে কর্মকর্তা অনেক বেশি হওয়ায় পদায়ন, বসার জায়গা ও দায়িত্ব নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে।
বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেছেন, জনপ্রশাসনে চার বছর ধরে ঢালাও পদোন্নতি হলেও পদগুলোকে সে অনুযায়ী উন্নীত (আপগ্রেড) করা হয়নি, নতুন করে পদ সৃষ্টি করা হয়নি। এ কারণে পদোন্নতি হলেও নতুন পদে বদলি বা পদায়নে জটিলতা আরও বাড়বে।
“বিষয়টি বেশ জটিল এবং এটা একদিন বা এক বছরের সৃষ্ট নয়। এখন মন্ত্রণালয় এই সমস্যা নিরসনে কিছু কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে,” বেনারকে জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি বলেন, এখন যুগ্ম সচিবদের পদে অতিরিক্ত সচিবদেরও পদায়নের সুযোগ করা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের নিজ পদে রাখা হয়েছে। মন্ত্রণালয়, বিভাগ, উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় সবাইকে পদোন্নতিপূর্ব পদে রাখা হচ্ছে।
“যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের পোস্টিং দেওয়াটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবে যারা পদোন্নতি না পেয়ে জ্যেষ্ঠ হয়েও কনিষ্ঠ হয়ে গেছেন তাদের জন্য বিকল্প কী করা যায় সেটি ভাবা হচ্ছে,” জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব।
নতুন পদোন্নতিতে দলীয় পরিচয় ও আস্থাভাজন কর্মকর্তারা প্রাধান্য পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও বিভিন্ন সংস্থা প্রধানের অন্তত ৩২ জন একান্ত সচিব (পিএস) পদোন্নতি পেয়েছেন।
পদোন্নতি দেওয়ার পর ৭ ও ৮ এপ্রিল সচিবালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা বেজায় খুশি। বিশেষ করে যেসব কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন তাঁরা বেশি খুশি হয়েছেন। কারণ, এই পদগুলোকে প্রশাসনের নীতিনির্ধারণী পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এসব পদে রয়েছে গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা। তবে পদ না থাকার কারণে অতিরিক্ত সচিব হয়েও অনেককে উপসচিবের দপ্তরেই কাজ করতে হবে।
৭ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, আরেক কর্মকর্তা নিজ কার্যালয়ে ছেড়ে মন খারাপ করে বসে আছেন। জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, বিসিএস মেধা তালিকায় তাঁর চেয়ে অন্তত পেছনে থাকা ২৬ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে, কিন্তু তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
একইদিন তথ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে দেখা যায়, চারবার পদোন্নতিবঞ্চিত এক কর্মকর্তা মন খারাপ করে বসে আছেন। বললেন, চারবার পদোন্নতি না দেওয়ার অর্থ তিনি যোগ্য নন, তাঁকে বাদ দেওয়া উচিত।
গণপদোন্নতি দিলেও ওই দুজনের মতো প্রায় ৭০০ কর্মকর্তা পদোন্নতি ‘বঞ্চিত’ হয়েছেন। এখন বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বিদ্যমান পদটিও হারানোর আশংকা রয়েছে ভারসাম্য রক্ষা বা ‘চেইন অফ কমান্ড’ রক্ষার জন্য।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ইতিহাসে এই প্রথম বড় ধরনের বিশৃংখল পরিস্থিতিতে পড়েছে প্রশাসন। প্রশাসনের ‘চেইন অফ কমান্ড’ ঠিক রাখা না গেলে সার্বিক উন্নয়ন কাজের গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে।
“এখন পদ না পেলেও যারা পদবী পেয়েছেন কিছুদিনের মধ্যেই তারাও হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। আর বঞ্চিতরাতো হতাশ আছেনই, ” জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন যুগ্ম সচিব।
সাম্প্রতিক এই পদোন্নতির ফলে একই মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান হয়ে গেছেন অধ:স্তন ব্যাচের কেউ, কিন্তু ঊর্ধ্বতন ব্যাচের কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে এখন কনিষ্ঠ হওয়ায় তার অধীন হয়ে পড়েছেন।
“একদিকে পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার কষ্ট অন্যদিকে পদমর্যাদার কষ্টে এখন চাকরিতে কীভাবে টিকে থাকব সেটি নিয়েই যন্ত্রণা,” বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদোন্নতিবঞ্চিত একজন উপ-সচিব।
দৃষ্টান্ত হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১৯৮২ ব্যাচের যারা এখন অতিরিক্ত সচিব হলেন তারা কীভাবে একই ব্যাচ, ৮৩ কিংবা ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তার অধীন কাজ করবেন।
প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার পর জনপ্রশাসনে সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১৮টি কমিশন বা কমিটি গঠন করে সংস্কারের নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি কখনও।
বরং অপরিকল্পিত কয়েকটি বিসিএস ব্যাচের কারণে প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও ভাল পদ পেতে রাজনৈতিক আশ্রয় খঁুজেছেন বার বার।
সর্বশেষ গত মহাজোট সরকারের সময়ে একটি আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটিও এখনো আটকে আছে। প্রথমে ‘সিভিল সার্ভিস আইন’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে সেখান থেকে থেকে সরে এসে প্রজাতন্ত্রের সব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের জন্য ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেটি করার আগেই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত এপ্রিল মাসে সচিব সভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনটি দ্রুত করার নির্দেশ দেন। এরপরও সেটি আটকে গেছে। তবে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত যেভাবে খসড়াটি করা হয়েছে তাতে আইনটি মূলত ‘দুর্নীতিবাজ’ কর্মকর্তাদের জন্য সহায়ক হবে। সাধারণ কর্মকর্তাদের সুরক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারবে না।
কারণ এ আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র (বিচার শুরু) গ্রহণের আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করতে হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে হাইকোর্ট তা অবৈধ ঘোষণা করে বাতিল করে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জনপ্রশাসনে এখন ভিন্নমতের কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া কঠিন। সরকারি দলের সমর্থকরাই প্রশাসনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। ভিন্নমতের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা থাকলেও তাঁর কোনঠাসা, ওএসডি বা কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করছেন।
একাধিক সাবেক কর্মকর্তা জানান, নব্বইয়ের পর থেকে প্রশাসনে দলীয়করণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রকাশ্যে দলীয়করণ শুরু হয় ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চের মাধ্যমে। তখন সাবেক সচিব মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে একদল কর্মকর্তা-কর্মচারী ওই মঞ্চে যোগ দিয়ে আলোচনায় আসেন।
পরে মহীউদ্দীন আলমগীর মন্ত্রী হন এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে প্রশাসনের ওইসব কর্মকর্তা ভাল ভাল পদ পান।
এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর এসব কর্মকর্তাকে ‘ শাস্তিমূলক ওএসডি’, বাধ্যতামুলক অবসর দেওয়া বা পদোন্নতি বঞ্চিত করা হয়। বিপরীতে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় তাদের পছন্দের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও ভাল পদ দেওয়া শুরু করে।
“এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটিই পথ - প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করে পদের মান বাড়ানোর পাশাপাশি প্রশাসনে বিশেষ করে জনবল কাঠামোতে বড় ধরনের সংস্কার আনা,” জানান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।
এদিকে বর্তমান সংকট নিরসনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। এতে দেখা গেছে, ২০১৯ সাল নাগাদ এক হাজার ১৮১ জন কর্মকর্তা অবসরে যাবেন।
আর এ বছরই অবসরে যাবেন ১৭০ কর্মকর্তা, এঁদের মধ্যে সচিব ১৯জন। ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ২৮১জন কর্মকর্তা অবসর নেবেন।
জনপ্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৮৫ বিসিএস পর্যন্ত কর্মকর্তারা অবসরে না যাওয়া পর্যন্ত এই সমস্যা কাটবে না। কারণ, ওই বিসিএস পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত কর্মকর্তা রয়েছেন।
“এখন থেকে ভেবেচিন্তে পদক্ষেপ নেওয়া হলে পাঁচ বছরের মাথায় প্রশাসনে স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে আসবে বলে ধারণা করা যায়,” বেনারকে জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সুবীর রায় চৌধুরী।