বিএনপি নেতা পিন্টু’র মৃত্যু, ‘পরিকল্পিত হত্যা’র অভিযোগ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.05.04
BD-politics পিন্টুর মরদেহ রাজশাহী থেকে ঢাকায় আনা হলে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তাকে দেখতে যান। ৪ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় কারাগারে মারা গেছেন বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল-বিএনপি নেতা নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু।তার মৃত্যুতে অনেকে ‘পরিকল্পিত হত্যার’ অভিযোগ তুলেছেন।

রোববার দুপুরে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অসুস্থ্য অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) পাঠানো হয়। তবে সেখানকার চিকিৎসকরা হাসপাতালে তাকে মৃত অবস্থায় পেয়েছেন বলে জানান। সোমবার ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এ মৃত্যুকে সরকারের ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলছে বিএনপি ও পিন্টুর পরিবার। তার চিকিৎসায় চরম অবহেলার অভিযোগও আনা হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

এদিকে পিন্টুর এই মৃত্যু বিএনপির রাজনীতিতে প্রভাব ফেলা ছাড়াও সরকার বিরোধীদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দীন পিন্টু বিডিআর বিদ্রোহের মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে জেল খাটছিলেন। এবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ায় তার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যায়।

সিটি নির্বাচনের আগে গত ২০ এপ্রিল তাকে ঢাকা থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক শফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “এখানে আনার কয়েকদিন পরে তিনি তিনি অসুস্থ বোধ করলে ২৬ এপ্রিল তাকে রাজশাহী মেডিকেলে পাঠানো হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা সেবার পর ওই দিনই তাকে আবারও কারাগারে ফেরত আনা হয়। সেখানে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী চিকিৎসা চলছিল তার। এ অবস্থায় শনিবার দুপুর ১২টার দিকে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। তখন কারাগার চিকিৎসকের পরামর্শে দ্রুত তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পরে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন”।

হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও চোখের সমস্যায় সমস্যার রোগী পিন্টুকে রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত অবস্থায় পান বলে বেনারকে জানিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন।

এদিকে শনিবার সকালে হাসপাতালটির পক্ষ থেকে পিন্টুকে চিকিৎসা সেবা দিতে  কারাগারে গেলেও কারা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।  রামেকের  হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ডা. রইছ উদ্দিন বেনারকে বলেন, “পিন্টুর চিকিৎসার ব্যাপারে কারা কর্তৃপক্ষের একটি চিঠি পেয়ে শনিবার সকালে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক আমাকে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেননি। বরং চা খাইয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বিষয়টি আমি হাসপাতালের পরিচালককেও জানিয়েছিলাম”।

এর ব্যাখ্যায় শফিকুল ইসলাম বলেন, “কারা প্রশাসন ২৫ এপ্রিল একজন চিকিৎসকে কারাগারে পাঠানো অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সময় মতো কেউ না আসায় ২৬ এপ্রিল পিন্টুকে ওই হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। তার পরবর্তি চেক-আপের কথা ছিল আগামী ১১ মে। এজন্যই চিকিৎসককে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল”।

পিন্টুকে পরিবার এ মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে বিচারের দাবি তুলেছে। আর বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা।

পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার কল্পনা বেনারকে বলেন, আমার স্বামী মারা যাননি। পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসায় অবহেলা করে তাকে হত্যা করেছে সরকার। হাইকোর্ট তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে রেখে চিকিৎসা করানোর আদেশ দিলেও সে আদেশ অমান্য করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আগে তাকে রাজশাহী নিয়ে যায়। সেখানে পরিকল্পিতভাবে তার চিকিৎসার অবহেলা করা হয়েছে।

দুই মাস আগে একটি রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে আদালত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও চক্ষু হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে পিন্টুকে চিকিৎসার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানান পিন্টুর আইনজীবী আমিনুল ইসলাম।

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও পিন্টুর মৃ্ত্যুকে হত্যাকান্ড দাবি করে এর বিচার চেয়েছেন। এর জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেছেন।

পিন্টুর মৃত্যুর জন্য কারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ নাকচ করে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বেনারকে বলেন, এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন। একজন বন্দি হিসেবে পিন্টুর যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান তাকে তা দেওয়া হয়েছিল।

পিন্টুর মৃত্যুকে সরকার সহজভাবে দেখলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সাদা চোখে দেখছেন না। তারা বলছেন পিন্টুর চিকিৎসায় চরম অবহেলা করা হয়েছে। আর কারা অন্তরীন এমন অবহেলায় মৃত্যুর ঘটনা বিএনপিসহ সরকারের সমালোচকদের নতুন আতঙ্কে ফেলবে।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনবিভাগের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল বলেন- ‘গুরুতর অসুস্থ্য রোগী পিন্টু কে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে তাকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং রাজশাহী মেডিকেলের হৃদরোগ বিভাগের প্রধানকে তার চিকিৎসা করার অনুমতি না দেওয়া- এই দুটো ঘটনা অন্তত এটুকু প্রমাণ করে যে, পিন্টুর মৃত্যুর পিছনে সরকারের বড় ধরনের অবহেলা আছে”।

তিনি বলেন, “পিন্টু জেলে বসে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একটি ভূমিকা রাখতে পারেন, -এই সামান্য আশঙ্কা থেকে এত বড় একজন রোগীকে ঢাকা সরিয়ে রাজশাহীতে পাঠানো হল। সরকার পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাকে খুন না করলেও আমি বলব তার চিকিৎসায় চরম অবহেলা এবং নিষ্ঠুর অবজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে”।

আর বিএনপিতে পিন্টুর এ মৃত্যুর প্রভাব সম্পর্কে ড. আসিফ বলেন, “শুধু বিএনপি নয়, যারাই সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন সমষ্টিগতভাবে তাদের জন্য সরকার একের পর এক এক আতঙ্কজনক চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। পিন্টুর মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকারের তেমনই একটি রুপ বেরিয়েছে”।

বিষয়টির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বিএনপির আরেক নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে যখন গুম করা হল তখন জেলে বাইরে বিএনপির নেতা কর্মীরা একদফা ভয় পেয়েছে এই ভেবে যে, সরকারের পক্ষে যেকোন কিছু করা সম্ভব। আবার পিন্টুর মত তাদের চিকিৎসায়ও সরকার সীমাহীন অবজ্ঞা দেখাবে ভেবে জেলে থাকা সকল বিএনপি নেতা কর্মীসহ মাহমুদুর রহমান মান্নার মত নেতারাও ভয় পাবেন”।

চিকিৎসায় অবহেলার ঘটনা মাহমুদুর রহমান মান্নার ক্ষেত্রেও হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একসময়ে ছাত্রদলের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক পরে সভাপতি এবং লালবাগ-কামরাঙ্গীরচর  আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এ বিএনপি নেতাকে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর পিলখানা হত্যা মামলার রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।