মোদীর সফরের পর বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে পর্যালোচনা
2015.06.12
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের থিতিয়ে পড়া সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের পর এই প্রশ্নটি জোরেশোরে আলোচনায় এসেছে।
নরেন্দ্র মোদীর সদ্য সমাপ্ত দুই দিনের ঢাকা সফরের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেন। ৭ জুন বিকেলে অনুষ্ঠিত প্রায় এক ঘণ্টার এই বৈঠকের অন্তত ১০ মিনিট তারা দুজন একান্তে কথা বলেন। এই একান্ত বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে এখনো কিছু আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।
তবে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বেগম জিয়ার বৈঠকের পর এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকার মাটিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সন্ত্রাস ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান স্পষ্ট করে গেছেন নরেন্দ্র মোদী।
ওই সাক্ষাতের কিছু সময় পর প্রেস ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ড. এস জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। আর তা হলো-আমরা গণতন্ত্রের সমর্থক এবং আমরা মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদেরও বিরোধী।”
সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে নরেন্দ্র মোদীর ওই অবস্থান, বিশেষ করে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদ বিরোধী বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক।
বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে গত ১০ জুন কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্টেটসম্যানের এক খবরে বলা হয়েছে, মোদী জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করার ইঙ্গিতই দিয়েছে বিএনপিকে।
বিএনপি-জামায়াত নিয়ে এই আলোচনার মধ্যেই গতকাল ১২ জুন বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বিএনপি সরকারের সময়কার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন, “বিএনপিকে বাঁচতে হলে জামায়াত নির্ভরতা ছেড়ে আবারও জিয়ার আদর্শে ফিরে আসতে হবে।”
ডা. বি চৌধুরী বিএনপি থেকে বের হয়ে বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলেন যার প্রেসিডেন্ট তিনি। রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
“বিএনপি এখন জিয়াউর রহমানের আদর্শের মধ্যে নেই। তারা এখন তৃতীয় স্টেজের রাজনীতি করছে। তাদের রাজনীতি এখন সম্পূর্ণ জামায়াতনির্ভর,” জানান ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
গত বছরের ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে প্রথম সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হতে পারে।
নির্বাচনের পর কূটনীতিকেরা সংলাপের তাগিদ দিলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, “তাঁরা (কূটনীতিকরা) সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন। সরকারও সংলাপে প্রস্তুত। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবে।’ (১৭ জানুয়ারি ২০১৪, দৈনিক ইত্তেফাক)
অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ওই আহ্বানের পর এশিয়া ও ইউরোপের কূটনীতিকরাও খালেদা জিয়াকে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শ দেন।(১১ জানুয়ারি, ডেইলি স্টার, প্রথম পৃষ্ঠা)।
কিন্তু খালেদা জিয়া নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তখনই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বান নাকচ করে দিয়ে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের দলের জোটবদ্ধ স্থায়ী কিছু নয়।(ইত্তেফাক, ৯ জানুয়ারি, ২০১৪)
তবে সরকারই এখন জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়ায় যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে দলটি নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেছেন, মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে উত্থাপনের জন্য সংশোধনীর খসড়াটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্টেটসম্যানের খবরে বলা হয়, জঙ্গিবাদ, দশ ট্রাক অস্ত্রসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছিল।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা জঙ্গিবাদ বিরোধী জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ এবং ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগগুলো দূর করতে সর্বাত্মক সহযোগিতা শুরু করলে দু-দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে খালেদা জিয়া সরকারি আমন্ত্রণে ভারত সফর করেন। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে ভারতের দূরত্ব কমার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে আবার বিরোধের সৃষ্টি হয়।
বিশেষ করে ২০১৩ সালের মার্চে সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ বাতিল করেন খালেদা জিয়া। ফলে নতুন করে ভারতের রাজনৈতিক দল ও সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে গড়া বিএনপির ১৮–দলীয় রাজনৈতিক জোট এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মামলায় একের পর এক ফাঁসির রায় ঘোষণা এবং দুটি ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর রাজনীতিতে জামায়াত অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
এরই মধ্যে সরকার জামায়াত নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া অনেক দূর এগিয়ে রেখেছে। অবশ্য এ নিয়ে বিএনপি এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
“জামায়াতকে নিয়ে কেবল ভারত নয়; বিশ্বের অনেক দেশের আপত্তি বা চাপ আছে। তা ছাড়া আমি মনে করি না যে জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি চলতে পারবে না,” বেনারকে জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান।
তাঁর মতে, “বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় ভারতের বিরুদ্ধে গিয়ে লাভ নেই। বরং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষার ভিত্তিতে কী করে সামনে এগোনো যায়, সে চিন্তাই করা উচিত।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার ৩৭ বছরের মধ্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন প্রশ্নে বিএনপি এখন একেবারে উল্টো পথে চলছে। অর্থাৎ ভারত বিরোধিতা দূরে থাক, বরং কতটা তাদের পক্ষে থাকা যায়, বর্তমান সরকারের সঙ্গে দলটি সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
কারণ বিএনপির নেতা কর্মীরা এখন বিশ্বাস করে, জনসমর্থন যতই থাক, ক্ষমতায় যেতে ভারতের সমর্থন একটি বড় বিষয়।
সর্বশেষ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটির মধ্যে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে। বলা হচ্ছে, শুধু ভারতের সমর্থনের কারণে সরকার যেনতেন একটি নির্বাচন করে ক্ষমতায় গেছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর ব্যর্থ আন্দোলনের পর দলটি গত বছরের মে পর্যন্ত ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করে। বিএনপির ধারণা ছিল, দিল্লিতে সরকার বদল হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়বে।
বিজেপি ক্ষমতায় এলে বিএনপিতে স্বস্তি ফেরে, তৈরি হয় প্রত্যাশাও। দলটির নেতারা নানাভাবে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন উদ্যমে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টাও চালায়।
বিজেপির বিজয়ের পরদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতিতে বিএনপি নেতা কর্মীরা এই বিজয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। তা ছাড়া আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণার আগেই বিএনপির পক্ষ থেকে মোদিকে অভিনন্দন জানিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের একটি বার্তা ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনে পাঠানো হয়।
ভারতের সহানুভূতি আদায়ে বিএনপি-জামায়াতও যে কতটা বেপরোয়া তার নজির ছিল খালেদা জিয়াকে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহর টেলিফোন করেছেন মর্মে বিএনপি নেতাদের অহেতুক বক্তৃতা–বিবৃতি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেন, ‘খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন ভারতে মোদি ক্ষমতায় এসেছেন।এবার একটা কিছু হবে।’ (২৩ ফেব্রুয়ারি, প্রথম আলো, পৃষ্ঠা–২)।
“বিএনপি ধারণা করেছিল, কংগ্রেসের কাছ থেকে ক্ষমতা বিজেপির হাতে গেলেই দলটি নতুন সরকারের আনুকূল্য পাবে। কিন্তু ক্ষমতা বিজেপির কাছে গেলেও বাংলাদেশ প্রশ্নে দেশটির অবস্থান আগের মতোই রয়েছে,” বেনারকে জানান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন–অর–রশিদ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বর্তমান সরকারের মাধ্যমে জঙ্গি দমন ছাড়াও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়–প্রশ্রয় না দেওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে ভারত। বিএনপি–জামায়াত জোট আমলে ভারত এসব বিষয়ে সহযোগিতা পায়নি।
গত ৩০ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকাতে শেখ হাসিনার জঙ্গিবিরোধী অবস্থানের প্রশংসা করেন।
১৯৯৯ সালে চারদলীয় জোট গঠনের সময় ঘোষিত যৌথ ইশতেহারে একসঙ্গে আন্দোলন, নির্বাচন ও সরকার গঠনের কথা বলা হয় এবং সে অনুযায়ী ২০০১ সালের নির্বাচনের পর জামায়াতের প্রভাবশালী দুই নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এর পর থেকেই জামায়াত-বিএনপি সম্পর্ক নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এরপর গত ১৪ বছর নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে সম্পর্ক টিকে থাকলেও বিএনপির বড় একটি অংশের এখনকার মূল্যায়ন হচ্ছে, জামায়াতের সঙ্গে সরকার গঠন করায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বিএনপির।
বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জামায়াত এখন আর বিএনপির সম্পদ নয়, বোঝা।”
দলটির মূল্যায়ন হচ্ছে, বিএনপিকে জড়িয়ে ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ তকমা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে জোট থাকায় প্রচার প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জঙ্গিবাদের সঙ্গে বিএনপিকে জড়িয়ে ফেলার সুযোগ পেয়েছে সরকার।
“একসময় জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠলেও রাজনৈতিক আলোচনায় তা স্থান পাচ্ছে না। ১৯৯৪ সালে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে মিলে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল,” টেলিফোনে বেনারকে জানান বিদেশে অবস্থানরত বিএনপি নেতা আ ন ম এহছানুল হক মিলন, যিনি বিএনপি সরকারের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
বর্তমান সরকারের সময়ে ৩৪ টি মামলার আসামি সাবেক ওই প্রতিমন্ত্রী জানান, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত যখন একসঙ্গে আন্দোলন করে তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া। পরে ২০০১ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে বিএনপি নির্বাচনে যায় এবং সরকার গঠন করে। এরপর থেকেই জামায়াত আওয়ামী লীগের কাছে খারাপ হয়ে যায়।
“একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আরেকটি দলের সম্পর্ক থাকবে কি থাকবে না, তা ঠিক করে দেওয়া সরকারের কাজ নয়। এটা সরকারের বাড়াবাড়ি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া কিছুই নয়,” মনে করেন এহছানুল হক।