ছাত্রী ধর্ষণের দায়ে সেই শিক্ষক পরিমলের যাবজ্জীবন

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.11.25
BD-porimal এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে তারই শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
বেনার নিউজ

দেশের শীর্ষস্থানীয়  ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে তারই শিক্ষক পরিমল জয়ধরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

স্কুলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় রাজধানীর রাস্তায় নেমে এসেছিল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকের আটকের দাবিতে যোগ দেয় সাবেক শিক্ষার্থী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও।

পরিমলের মামলার রায়ের পর আন্দোলনকারীরা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ন্যায়বিচার দরকার ছিল।

তাদের মতে, ভিকারুননিসার শিক্ষার্থীরা তাদের অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের অন্যান্যদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং সেটা জাগরুক রেখেছিলেন বলেই এই বিচার পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

মামলা হওয়ার চার বছর পর ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক মো. সালেহ উদ্দিন বুধবার আসামির উপস্থিতিতে এই রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি পরিমলকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ওই টাকা দিতে না পারলে আরও ছয় মাস সাজা খাটতে হবে তাকে।

রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কৌঁসুলি ফোরকান মিয়া জানান, জরিমানার টাকা ধর্ষণের শিকার ওই ছাত্রীকে দিতে বলেছে আদালত।

৩০ পৃষ্ঠার রায় পড়ে শোনানোর সময় মামলার তদন্তে ‘দুর্বলতা’ ছিল বলে মৌখিকভাবে উল্লেখ করেন বিচারক।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন পুলিশের পরিদর্শক এস এস শাহাদাৎ হোসেন ও পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব এ খোদা। বিশেষ করে পরিদর্শক শাহাদাৎ এই মামলার তদন্তে চরম অদক্ষতা ও গাফিলতি দেখিয়েছেন।

রায়ের পর আদালত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পরিমল সাংবাদিকদের  বলেন, “ আমি নির্দোষ। আর কিছু বলতে আমার হাত-বা বাঁধা।”

তার আইনজীবী মাহফুজ মিয়া জানান, এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

এ মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফোরকান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি, তাই আদালত তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন।”

রাজধানীর খ্যাতনামা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা ক্যাম্পাসের শিক্ষক পরিমলই ছিলেন এ মামলার একমাত্র আসামি। আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন তিনি।

গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ার লাটেংগা গ্রামের পরিমল ২০১০ সালে ভিকারুননিসার বসুন্ধরা শাখায় বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

২০১১ সালে করা মামলায় ভিকারুননিসার তৎকালীন অধ্যক্ষ হোসনে আরা এবং বসুন্ধরা শাখার প্রধান লুৎফর রহমানকে আসামি করেছিলেন ধর্ষিত ছাত্রীর বাবা। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ আদালতে অভিযোগ গঠনের সময় অধ্যক্ষ ও লুৎফরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

মামলায় অভিযোগ করা হয়, ওই ছাত্রীকে প্রলোভন দেখিয়ে ২০১১ সালের ২৮ মে প্রথম ধর্ষণ করেন পরিমল। ওই সময় ছাত্রীর নগ্ন ভিডিও চিত্র মোবাইলে ধারণ করা হয়। এরপর ওই ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে ১৭ জুন আবারও ধর্ষণ করা হয়।

বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর ভিকারুননিসার ছাত্রীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন পরিমলকে বরখাস্ত করে।

এরপর ৫ জুলাই ওই ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এই মামলা দায়ের করেন।

এর একদিন বাদে পরিমলকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে তার স্ত্রীর বড় বোনের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন তিনি।

মামলার শুনানিতে বিচারকের কাছে ওই ছাত্রী পরিমলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন বলে বাদীপক্ষের আইনজীবী জিল্লুর রহমান তালুকদার জানান।


ছাত্রী আন্দোলন থেকে জাতীয়  আন্দোলন

২০১১ সালে অভিযোগ উত্থাপিত হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ তা আমলে না নিলে আন্দোলনে নামে বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালের ২৮ জুন পরিমলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বাক্ষরিত আবেদন জমা দেয়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নেওয়ায়  আন্দোলন করতে হয়েছে এবং এক পর্যায়ে এটি জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য সংহতি মঞ্চ’ আয়োজিত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে দাবি করা হয়, শিক্ষার্থীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন থেকে উপলব্ধি হয়েছে, এখন সময় এসেছে নীরবতা ভেঙে, লজ্জা ও অপমানের যন্ত্রণাকে লড়াইয়ের শক্তিতে পরিণত করার।

“ছাত্রীদের ওই আন্দোলন সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন করে তোলার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। আশার কথা হচ্ছে মেয়েরা প্রতিবাদ করতে শিখেছে এবং বিচার পেয়েছে,”  আন্দোলন সম্পর্কে জানান অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।