সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে উন্নয়নের গতি বাড়াতে চায় সরকার
2016.03.03
সরকার আন্তরিকভাবে চাইলেও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে খুবই কম। আবার যেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে, সেগুলোতে বেসরকারি অংশীদারেরাই মূলত লাভবান হচ্ছে। এই বাস্তবতার মধ্যেও সরকার পিপিপি কর্মসূচি এগিয়ে নিতে এবং এটাকে জনপ্রিয় করতে চায়।
সরকারি হিসেবে, পিপিপির পাইপলাইনে পরিবহন, পর্যটন ও অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতের ৪৩টি প্রকল্প রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নে বেসরকারি খাত থেকে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ আসতে পারে।
ইতিমধ্যে পিপিপি কারিগরি তহবিলের ৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৮টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে; যেখানে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রথম বোর্ড অব গভর্নরসের সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন, যিনি পিপিপি বোর্ড অব গভর্নরসের সভাপতি।
“দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আরও জোরদার করতে ও দ্রুত গতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী,” বেনারকে জানান প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
“প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দ্রুত উন্নতি করতে চাই। এটা শুধু সরকারি বিনিয়োগে সম্ভব নয়। সে জন্য দরকার পিপিপি’।”
পিপিপি বাস্তবায়নের কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশও দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সরকার দেশের উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে চায়। তবে, সরকারের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়। এ জন্য পিপিপি’র সহযোগিতা প্রয়োজন।”
এ প্রসঙ্গে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, সেখানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সভায় বিগত কয়েক বছরের পিপিপি কার্যক্রমের বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। এসময় পিপিপি প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন, বেসরকারি অংশীদার নির্বাচন ও চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর এবং সামগ্রিক বিনিয়োগের সম্ভাব্য পরিমাণ ও সময় সম্পর্কে সভাকে অবহিত করা হয়।
এতে জানানো হয় যে ৬টি প্রকল্পের চূড়ান্ত চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি অংশীদার নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১১টি প্রকল্পে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হতে পারে। সম্ভাব্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগে ১০টি প্রকল্প সমীক্ষার কাজ যাচাই পর্যায়ে রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পিপিপির বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ১২শ কোটি টাকা ব্যয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, মংলা বন্দরে দুটি জেটি নির্মাণ, ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে শান্তিনগর–মাওয়া ফ্লাইওভার নির্মাণ, দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা–আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ঢাকা বাইপাস মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীতকরণ, ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে মিরপুর স্যাটেলাইট স্থাপন, এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারে পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ, ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ধীরাশ্রমে আইসিডি নির্মাণ, ১২শ কোটি টাকা ব্যয়ে তৃতীয় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প প্রভৃতি।
পিপিপি–তে পদ্ধতিগত প্রস্তুতিতে সরকার দুর্বল ছিল বলে এর আগে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। গত জুনে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ২০১৫-২০১৬ সালের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ বিষয়টি স্বীকার করেন।
প্রস্তাবিত বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, “সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) বাস্তবায়নে গত ছয়টি বছর আমি অনেক বক্তব্য রেখেছি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে তেমন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নেই। স্বীকার করতেই হবে যে, পদ্ধতিগত প্রস্তুতি আমাদের দুর্বল ছিল। তবে পিপিপি বিল আইনে রূপ নিলে এর প্রতিবন্ধকতা দূর হবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।”
গত সেপ্টেম্বরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব আইন, ২০১৫ পাস হয়। এরপর গঠন করা হয় পিপিপি কর্তৃপক্ষ ।
এই আইন ও কর্তৃপক্ষ হওয়ার আগে পিপিপির আওতায় দেশের প্রথম বড় প্রকল্প হানিফ ফ্লাইওভার চালু হয়। ওই প্রকল্প চালু হলেও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে এটা নিয়ে সমালোচনা আছে।
দেশের বড় একটি শিল্প গ্রুপ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে সহজ ঋণ নিয়ে, সরকারের জমি ব্যবহার করে এবং দীর্ঘ সময় লাগিয়ে ওই ফ্লাইওভার তৈরি করে। এরপর সরকারের সঙ্গে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে বাড়তি টোল নির্ধারণ করে। এ নিয়ে আপত্তি জানালে প্রতিষ্ঠানটি মামলা করে আইনি সুরক্ষা নিয়ে পছন্দমতো কার্যক্রম চালাচ্ছে।
গতকালের সভায় বলা হয়, সংশ্লিষ্ট আইন মোতাবেক বোর্ডের চেয়ারপারসন হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পলিসি ইস্যু এবং পিপিপি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব প্রকল্প বাস্তবায়নের বাধা নিরসনের বিষয় তদারকি করবেন। এ ছাড়া, সভায় আনসলিসিটেড প্রস্তাবসমূহ চিহ্নিত ও প্রক্রিয়াকরণে এক গাইড লাইন পেশ করা হয়।
“পিপিপির প্রকল্প পর্যালোচনা করে নেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয়, মুনাফা বণ্টন, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রভৃতি বিষয় চূড়ান্ত করে আগ্রহী বেসরকারি খাতকে অংশ নিতে বলা উচিত। কিন্তু এসব কাজ এখন পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে বলে মনে হয় না,” জানান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তবে তিনি মনে করেন, সুষ্ঠুভাবে এই পদ্ধতির বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হতে পারে।