ভূমিকম্পে বাংলাদেশে নিহত ৫ ভারতে ৮, স্মরণকালের বড় ঝাঁকুনি
2016.01.04
মসজিদের শহর ঢাকায় সোমবার ভোরে ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। এর কারণ ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি খেয়ে বেশির ভাগ মানুষই ভোররাতে বাসা ছেড়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়েন।
এরপর ফজরের আজান পড়ে যায়। অনেকেই বাসায় না ফিরে মসজিদে নামাজ আদায় করেন। বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ায় তাঁরা সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। এ ছাড়া ভূমিকম্পের ঝাঁকুনির সময় শহরজুড়ে কলেমা পাঠ ও আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়।
সারা দেশের প্রায় সব মানুষ গতকাল সোমবার খুব ভোরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিছানা ছেড়েছেন। কারণটা ছিল ভূমিকম্প, যা নগরবাসীকে ভয়াবহ এক দুর্যোগের ঝুঁকিতে রেখেছে।
নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহ পার না হতেই দুয়ারে হানা দিল এই দুর্যোগ, যার ফলে বাংলাদেশ ছাড়াও মিয়ানমার আর ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রায় পুরোটাই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়েছে।
গত ১১ দিনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মোট ছয়টি বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য সবাই দুর্যোগের ওই আঘাতে বিপর্যস্ত হয়েছে।
ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙার পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টায় হুড়োহুড়ির মধ্যে ‘আতঙ্কিত হয়ে’ ঢাকা, জামালপুর, রাজশাহী, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাটে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে । আহত হয়েছেন শতাধিক। আর আতঙ্কিত করে দিয়ে গেছে সমগ্র দেশবাসীকে।
ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় মাঝারি হলেও বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় স্মরণকালের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ঝাঁকুনি। ঢাকার প্রবীণেরাও এত বড় ঝাঁকুনির কথা স্মরণ করতে পারেন না।
“ঢাকায় এত বড় কম্পনের ঘটনা আমার জীবনে ঘটেনি,” বেনারকে জানান আবদুস সাত্তার ((৬৩), যিনি ঢাকার গ্রীণরোডে গতকাল ভোরে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প (সাত দশমিক চার মাত্রার) হয়েছিল ১৯১৮ সালে যা শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এরপর এত কম্পন আর হয়নি।
গতকালের ওই দুর্যোগের উৎসস্থল ছিল দেশের বাইরে, তবু সারা দেশকে কাঁপিয়ে, আতঙ্কিত ও উদ্ভ্রান্ত করে ফেলেছিল। বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটা সাত মিনিটে সৃষ্টি হয়েছিল সেই দুর্যোগ। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬ দশমিক সাত।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সকালে এই ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ছিল মনিপুরের ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার পশ্চিম উত্তর-পশ্চিম এবং ঢাকা থেকে ৩৫২ কিলোমিটার পূর্ব উত্তর-পূর্বে ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি।
“মণিপুরের ওই অঞ্চলটি পৃথিবীর ষষ্ঠ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। ভূতাত্ত্বিক ভাষায় এ অঞ্চলকে আমরা আরাকান ব্লাইন্ড মেগাথ্রাস্ট হিসেবে গণ্য করে থাকি-যা ইন্ডিয়ান ও বার্মা ভূতাত্ত্বিক প্লেটের একটি সক্রিয় সংযোগস্থল,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. মাকসুদ বলেন, এলাকাটি ৫০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে প্রলম্বিত এবং সর্বোচ্চ ৮.৬ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে। ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মনিপুর জেলা এবং বাংলাদেশের সিলেট, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলা এই মেগাথ্রাস্টের অংশ। মাত্রা ও গভীরতার বিচারে গতকালের ভূমিকম্পকে মাঝারি-শক্তিশালী অগভীর (শ্যালো ফোকাস) ভূমিকম্প বলা হয়।
ভারতে নিহতের সংখ্যা ৮ জন
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মণিপুর রাজ্যে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮ জনে পৌঁছেছে। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১০০ জন। আজ সোমবার স্থানীয় সময় ভোর চারটা ৩৬ মিনিটে সেখানে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা ছিল ৬ দশমিক ৭।
টাইমস অব ইন্ডিয়া অনলাইনের খবরে জানানো হয়, উৎপত্তিস্থল ইম্ফলে অনেক ঘরবাড়িতে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ভবনের দেয়ালও ধসে পড়েছে। দেশটির আসাম, মণিপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে অনেকেই জানিয়েছেন এসব জায়গার অনেক ভবনে ফাটল ধরেছে।
হৃদরোগে পাঁচজনের মৃত্যু
বগুড়ায় ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আহমদ আলী (৫০) নামে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী দিনমজুর মারা গেছেন। সোমবার ভোররাতে ভূমিকম্পের সময় পরিবারের সদস্যদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে আহমদ আলী নিজেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাৎক্ষণিক মারা যান। আহমদ বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটরা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুর্জয়পুর গ্রামের বাসিন্দা।
আতঙ্কিত হয়ে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার ঘোনাবাড়ি কদুর বাজার এলাকার মৃত নজর উদ্দিনের ছেলে নূর ইসলাম ওরফে কদু (৫৫) নামের মুদি দোকানদার মৃত্যু বরণ করেছেন মর্মে জানা যায়।
ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে গতকাল ভোরে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী মারা গেছেন। ওই কর্মচারীর নাম খলিলুর রহমান(৬৫)। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ডাইনিংয়ের প্রধান বাবুর্চি ছিলেন। তার বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী মেহেরচণ্ডি এলাকায়।
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় ভূমিকম্প আতঙ্কে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সোনা মিয়া (৩৮) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটি আজ ভোর পাঁচটা ১৫ মিনিটের সময় ওই উপজেলার দুরমুঠ ফুলতালা গ্রামে ঘটেছে। নিহত সোনা মিয়া ইসলামপুর উপজেলার গাঁওকুড়া গ্রামের মৃত বশির শেখের ছেলে। তিনি ইসলামপুর বাজারে একটি কাপড়ের দোকানের খলিফা ছিলেন।
সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে ভূমিকম্পের আতঙ্কে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আবুল কাশেম (৪০) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার ভোর পাঁচটা ১০ মিনিটের সময় এই ঘটনা ঘটে। নিহত বেলকুচি উপজেলার বওড়া গ্রামের আব্দুর রশিদের ছেলে।
লাফ দিয়ে আহত শতাধিক
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক আহতদের সবাই তাড়াহুড়া করে বাইরে বের হতে গিয়ে কিংবা লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে চেয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের সময় এটা করা একেবারেই নিষেধ।
চট্টগ্রামে পুলিশের দুই সদস্য ভূমিকম্পের ভয়ে ছুটোছুটি করতে গিয়ে আহত হন। এ ছাড়া ঢাকায় ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে দুইতলা থেকে লাফিয়ে পড়ায় কনস্টেবল সোহানের দুই পা ভেঙে গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ শিক্ষার্থী একইভাবে আহত হওয়ায় ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সর্বসাধারণের অজ্ঞতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একজন দায়িত্বরত কর্মী জানান, সকাল থেকে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রয়েছেন ।
এদের মধ্যে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের এক শিক্ষার্থী পাঁচতলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত হয়েছেন। এছাড়া মহসিন ও কবি জসিম উদ্দীন হলের দোতলা থেকেও পাঁচজনের লাফিয়ে পড়ে আহত হন।
মেডিকেল ফাঁড়ির পরিদর্শক মোজাম্মেল বলেন, “কেউ দোতলা থেকে, কেউ তিনতলা থেকে লাফিয়ে, কেউবা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নামার চেষ্টার সময় আহত হয়েছেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আমজাদ আলী ১৬ জনকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
১২ জনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল ও মেডিকেল টিম। আর বাকি চারজনকে বন্ধু সহপাঠীরা হাসপাতালে নিয়ে যান।
আতঙ্কে হুড়োহুড়িতে আহত হয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেছেন ৩২ জন।
ভূমিকম্পের পর ঢাকার বংশাল ও শনির আখড়ায় দুটি ভবন হেলে পড়েছে; ফাটল দেখা দিয়েছে শাঁখারীবাজারের একটি বাসায়। প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো নিয়ে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিছূ ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে।
আরও হবে, প্রস্তুত থাকার পরামর্শ
এ বছর আবহাওয়াজনিত নানা ঝক্কি-ঝামেলার মধ্য দিয়ে যাবে সেই পূর্বাভাস আগেই দিয়েছিল বিশ্বের আবহাওয়া বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সংস্থা গুলো।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায়। কাজেই এখানে ভূমিকম্প হবেই। তাই ভূমিকম্প সম্পর্কে সচেতন হওয়া, অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা, ভূমিকম্প পরবর্তী জরুরি উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের প্রস্তুতি নেওয়া অতি জরুরি।
এ বছর এল নিনো মারাত্মক শক্তিশালী অবস্থায় বিরাজ করছে।এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। এর প্রভাবে বাতাসের গতিবেগ, বৃষ্টিপাত এবং ঋতুচক্রের স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
“হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণী থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত একটি প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একটি বিস্তৃত ফাটল রেখা সম্প্রতি ধরা পড়েছে। ওই ফাটল রেখার মধ্যে বাংলাদেশও পড়েছে। ফলে বাংলাদেশে আগামী দিনগুলোতে আরও ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে,” বেনরাকে জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদি হাসান আনসারি।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ আনসারি বলেন, ওই এলাকায় গত কয়েক বছরে ১০ টি তীব্র ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়েছে।এ বছর নেপালে দুটি ভূমিকম্পে নিহতের মোট সংখ্যা ছিল আট হাজার ৫৮৩ জন।
এটা আল্লাহর রহমত: ত্রাণমন্ত্রী
ভূমিকম্পে বাংলাদেশ কেঁপে উঠলেও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হওয়াকে ‘আল্লাহর রহমত’ বলছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ।
সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত ধর্মভীরু । এ দেশে আল্লাহর রহমত আছে।”
মন্ত্রী মায়া বলেন, “আমি মনে করি, ঢাকার মাটি ভূমিকম্পকে সহনশীল করতে পারে। সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলেও ঢাকায় ক্ষতি হবে বলে আমার মনে হয় না, এটা আমার আত্মবিশ্বাস।”
ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযান চালাতে ৬৯ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আরও ১৪৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনতে দরপত্র ডাকার প্রক্রিয়া চলছে।
ঢাকায় ৭২ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জানিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব শাহ কামাল বলেন, বিল্ডিং কোড বাস্তবায়নে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
“ঝুঁকিপূর্ণ ভবন লাল রং করে দিলাম, এক মাস পরে সেই লাল রং সাদা হয়ে যায় কিন্তু বিল্ডিং ভাঙে না,” ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো এখনো না ভাঙায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মায়া।