ব্লগার রাজীব হত্যায় ২ জনের মৃত্যুদন্ড, ৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা
2015.12.31

প্রথমবারের মত একজন ব্লগার হত্যা বিচারের রায় দিয়েছে বাংলাদেশের আদালত। বৃহস্পতিবার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় দুইজনের ফাঁসি ও একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র পলাতক রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম দীপ। আসামি মাকসুদুল হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন বছর পর বৃহস্পতিবার ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহম্মেদ তিন বছর আগের এ মামলায় রায় ঘোষণা করেন। তবে সকল আসামির সার্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রাজীবের পরিবারও প্রগতিশীল সমাজ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজনকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানার আদেশও দেওয়া হয়েছে। ওই হত্যাকান্ডের অন্যতম আসামি মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আজাদ রানা পলাতক রয়েছেন। মামলার আট আসামির মধ্যে জসীমউদ্দিন রাহমানী ছাড়া বাকি সবাই নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। এদের মধ্যে মাকসুদুল হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক।
বাকি পাঁচজনের মধ্যে এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত। আনসারুল্লাহ প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীকে ৫ বছরের কারাদণ্ডসহ দুই হাজার টাকা জরিমানা; অনাদায়ে আরও দুমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে ৩ বছরের কারাদণ্ডসহ দুই হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। রায় ঘোষণার সময় আসামীরা স্থির ছিলেন। তবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তাদেরকে বিড় বিড় করতে দেখা যায়।
তদন্ত শেষে গত বছরের ২৮ জানুয়ারি জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ ওই আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ। আর এবছরের ১৮ মার্চ তাদের সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত।
‘ন্যায়বিচার পাইনি’- অভিযোগ রাজীবের বাবা
রায়ে হত্যাকান্ডের উসকানিদাতা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ সকল আসামির সর্বোচ্চ সাজা না হওয়ায় ন্যায় বিচার না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন। রায়ে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নাজিম উদ্দিন বলেন, “আমি ন্যায়বিচার পাইনি। আমি হতাশ। রায়ে মৌলবাদের জয় হয়েছে। আমরা যারা নীরিহ, মুক্তমনা, তাদের পরাজয় হলো।”
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই হওয়া উচিত ছিল। দুইজনের ফাঁসি দিয়ে অপর আসামিদের ১০ বছর, পাঁচ বছর ও তিন বছরের দণ্ড হত্যার সাজা হতে পারে না। এটা প্রভাবিত রায়; রায়ে বিচার বিভাগের ব্যর্থতা বেরিয়ে এসেছে”।
রায়ের ব্যাখ্যা
রায়ে আসামিদের দেওয়া দন্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে সাজার ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়,আসামি দীপের চাপাতির আঘাতে রাজীবের মৃত্যু হয়। এ কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনিক সেই চাপাতি কিনে এনেছিলেন বলে তাকে যাবজ্জীবন দিয়েছে আদালত। এছাড়া আদালতে দেওয়া সাদমান ইয়াসির মাহমুদের ‘জবানবন্দির ভিত্তিতে’ তার তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, আনসারুল্লাহ প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীর যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে হত্যাকাণ্ডে তার নিজের বা অন্য আসামিদের কারও সম্পৃক্ততার কথা আসেনি। তবে তার খুৎবায় অনুপ্রাণিত হয়েছে এ সব আসামিরা। যে কারণে তার বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ আসে। তার শাস্তি পাঁচ বছরের।
রায়ে আরো বলা হয়, আসামিপক্ষ থেকে কেউ সাজা কমানোর দাবি করেনি; সবাই খালাস চেয়েছেন। কিন্তু খালাস দেওয়ার মতো কাউকে পাইনি। হত্যায় অংশগ্রহণের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
গত সোমবার এ মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে রায়ের দিন ঠিক করেন আদালত।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ আন্দোলন শুরুর দশম দিনে বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর কুপিয়ে হত্যা করা হয় রাজীবকে। এঘটনায় রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিনের করা মামলার তদন্তে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে উঠে আসে। পেশায় স্থপতি রাজীব ব্লগ লিখতেন ‘থাবা বাবা’ নামে, যেখানে ধর্মান্ধতা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতাকারীদের বিপক্ষে লিখতেন তিনি।
সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে: আইনমন্ত্রী
রাজিব হত্যা মামলার রায়ে প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বেনারকে বলেন, এ রায়ে সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে। সরকার আইনের শাসনে বিশ্বাসী। এ রায়ের ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
রায় প্রত্যাখ্যান গণজাগরণ মঞ্চের
এদিকে ব্লগার রাজীব, যিনি গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীও ছিলেন, তাকে হত্যার মূল উসকানিদাতার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় রায় 'প্রত্যাখ্যান' করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।
বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও মশাল মিছিল করে করে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের বিচারে 'সরকারের সদিচ্ছা' নিয়েও প্রশ্ন তোলেন রাজীবের সহযোদ্ধারা।
সমাবেশে মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “যে কোন মামলায় অপরাধের উসকানিদাতাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু এই মামলায় প্রধান ব্যক্তিকে দেওয়া হলো মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। আবার যে দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদের একজন এখনও পলাতক। এই রায় কোনোভাবে জনগণের প্রত্যাশিত নয়, আমরা এই রায় প্রত্যাখ্যান করছি।”
এ ধরনের রায় রাষ্ট্রে জঙ্গিবাদের পুনর্বাসনের পক্ষে গিয়েছে মন্তব্য করে গণজাগরণ মঞ্চের এই মুখপাত্র বলেন, “এখানে বিচারের নামে প্রহসন হয়েছে। অপরাধীদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকার অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কোনো অপরাধীই আইনের বাইরে যেতে পারে না।”
সমাবেশে রাজীব হায়দারের বাবা নাজিম উদ্দিন বলেন, “আত্মস্বীকৃত খুনিরা কীভাবে পার পেয়ে যায়, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। বিচারে প্রধান উসকানিদাতার সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি। আবার যে দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাদের একজন এখনও পর্যন্ত পলাতক রয়েছে। এই ‘ত্রুটিপূর্ণ ও অসঙ্গতির’ রায়ের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।”
তবে এ রায়কে মুক্তমনাদের উপর হামলাকারীদের উপযুক্ত জবাব বলেও মনে করছেন অনেকে। এ বিষয়ে সাংবাদিক জাকিয়া আহমেদ বেনারকে বলেন, “রাজীবের আগে একইভাবে হত্যা করা হয়েছিল মুক্তমনা লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে। আমরা সে হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও দেখতে পারিনি। বৃহস্পতিবার দেওয়া রাজীব হত্যা মামলার রায় সেই হিসেবে বিচার না পাওয়ার সংস্কৃতি থেকে আমাদের রেহাই দিয়েছে। ব্লগারদের উপর হামলার উপযুক্ত জবাব এ রায়। রাজীবের পরেও খুন হয়েছে একাধিক ব্লগার। আশা করছি শীঘ্রই সেসব হত্যার ন্যায় বিচার পাবে স্বজনরা।”