রানা প্লাজাঃ ২৪ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
2015.12.21

বাংলাদেশের সাভারে মর্মান্তিক রানা প্লাজা ধসের মামলায় ২৪ জন পলাতক আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।
এ ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণের পর ঢাকার জ্যেষ্ঠ্ বিচারিক হাকিম মোহাম্মদ আল-আমিন এ আদেশ দেন। ২০১৩ সালের ওই ঘটনার পর প্রথমে 'অবহেলাজনিত মৃত্যুর' অভিযোগ এনে মামলা করা হলেও পরবর্তীতে ঘটনাটিকে 'পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড' উল্লেখ করে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।
আগামী ২৭ জানুয়ারি দিন মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধায্য করা হয়েছে। সেদিন পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকেও নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, “২৩ জন পলাতক আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার পাশাপাশি তাদের মালামাল জব্দ করতে আদেশ দেন বিচারক। এছাড়া পরবর্তি শুনানির দিন (২৭ জানুয়ারি) পরোয়ানাভুক্ত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট থানাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।”
রানা প্লাজা ধসের মামলার অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যাদের মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত সোহেল রানা কারাগারে রয়েছেন, ২৪ জন পলাতক আছেন এবং ১৬ জন জামিন পেয়েছেন।
আসামী যারা
চাঞ্চল্যকর এই মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন, ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক ও মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র আলহাজ রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আবু বক্কর সিদ্দিক, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান।
আরো আছেন, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সাবেক উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপ-প্রধান পরিদর্শক মো. জামশেদুর রহমান, উপ-প্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. ইউসুফ আলী, মো. শহিদুল ইসলাম, ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন, ইথার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মো. শফিকুল ইসলাম ভূইয়া, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, রেজাউল ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, নয়ন মিয়া, মো. ইউসুফ আলী, তসলিম ও মাহবুবুল আলম।
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ৫ সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র
এদিকে যেসকল আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তা। এরাও পলাতক রয়েছেন। সরকারী অনুমোদন ছাড়াই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়, আদালতও সেভাবেই গ্রহণ করেছেন। যার ফলে উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এই পাঁচ কর্মকর্তা হলেন- আব্দুস সামাদ, জামশেদুর রহমান, বেলায়েত হোসেন, ইউসুফ আলী ও সহিদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো বেনারকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী- সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করায় মামলাটির বিচার উচ্চ আদালতে গিয়ে ঝুলে যেতে পারে বলে মনে করেন ফৌজদারি মামলায় অভিজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো।
তবে পুলিশ পরিদর্শক আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে বারবার মঞ্জুরি আদেশ চাওয়া হয়। এর কারণে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়টিও বিলম্বিত হয়েছে। তবে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পরে ‘তারা জড়িত নয়’ মর্মে আদালতে প্রতিবেদন পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু আদালতের কাছে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় মঞ্জুরি আদেশ ছাড়াই চার্জশিট গ্রহণ করেছেন।”
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আটতলা ভবন রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হন ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কর্মরত আরো ১ হাজার ৫শ’ ২৪ জন শ্রমিক। এ ঘটনা সারা বিশ্বে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
চলতি বছরের ১ জুন ওই ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম ৪২ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
এরপর ৮ জুলাই ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক ছয় আসামির বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত ৫ সরকারি কর্মকর্তার ক্ষেত্রে মঞ্জুরি আদেশ না থাকায় একাধিকবার শুনানি পেছানো হয়।
দুই মামলার মধ্যে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে রানা, তার মা ও বাবাসহ ১৭ জন দুই মামলাতেই আসামি হওয়ায় মোট আসামির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ জন।
হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে রাষ্ট্রপক্ষে ৫৯৪ জন এবং ইমারত আইনের মামলায় ১৩০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
‘বিচার প্রক্রিয়ার গতি শ্লথ’
রানা প্লাজা ধসের আলোচিত মামলাটির বিচার প্রক্রিয়ার শ্লথ গতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। দ্রুত এ বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তাগিদ দিয়ছেন তারা।
শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ জাফরুল হাসান বেনারকে বলেন, “রানা প্লাজা ধসের আলোচিত মামলার অগ্রগতি অত্যন্ত শ্লথ। এই বিলম্ব বা শ্লথ গতি বিচার পাওয়ার বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্তদের বিচার পাওয়ার বিষয়টি সন্দিহান করে তুলছে। ওই মামলায় অভিযুক্ত একজন ছাড়া বাকিরা পলাতক ও জামিনে রয়েছে। শুধুমাত্র সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই পলাতক আসামীরা আটক হচ্ছে না বলে আমি মনে করি।”
তিনি বলেন, “এই ঘটনার বিচার যত দ্রুত হবে, আমাদের দেশের ব্যবসার ভাবমূর্তি তত বাড়বে। তাই নিজেদের স্বার্থেই এ বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা উচিত।”