ঢাকার রাস্তায় কর্মজীবী নারী গণধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড়

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.05.26
BD-rape গারো তরুনী ধর্ষণের ঘটনায় ঢাকায় রোববার বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ। ২৪ মে,২০১৫
বেনার নিউজ

নিত্য দিনের মত কাজ শেষে ঘরে ফেরার অপেক্ষা করছিল কর্মজীবী তরুণী। রাত তখন মাত্র নটা। অন্যান্য দিনের চেয়ে বাসের আনাগোনা বেশ কম। তাই অপেক্ষাটা বাড়ছিল। তেমনই সময় সামনে এসে থামে একটি মাইক্রোবাস। কিছু বুঝে ওঠার আগেই টান দিয়ে তাকে তুলে নেয় কয়েকজন যুবক।

সংখ্যায় তারা পাঁচজন। অস্ত্রের মুখে মেয়েটিকে সেই চলন্ত মাইক্রোবাসেই দেড় ঘণ্টা ধরে গণধর্ষণ করে তারা। এরপর ছুড়ে ফেলে দেয় রাস্তায়। এ ঘটনায় মামলা করতে সেদিন রাত থেকে পরদিন দুপুর পর‌্যন্ত বিভিন্ন থানায় ঘুরতে হয় মেয়েটিকে। তবে সাহস না হারিয়ে এই নির্মমতার বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন তিনি ও তার পরিবার।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ঘটনাটি ঘটে। এরপর শুক্রবার ভাটারা থানায় মামলা করেছে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির পরিবার। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামতও পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।জাতিতে গারো এই তরুণি ঢাকায় কাজ করার পাশাপাশি ময়মনসিংহের একটি কলেজে স্নাতক প্র্রথম বর্ষের ছাত্রী। তাদের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়ায়।


বর্ষবরণের উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় বিভিন্ন সংগঠনের আন্দোলনের মধ্যেই ধর্ষণের এ ঘটনা ঘটল। এতে করে আরো উত্তাল হল আন্দোলন। সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই এ ধরনের অপরাধের মাত্রা দিন দিন  বাড়ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নারী অধিকারকর্মীরা।

পুলিশ বলছে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তবে মামলার করার তিনদিন পরেও কোন আসামি ধরা না পড়ায় পুলিশ ‘নিস্ক্রিয়’ বলে বিভিন্ন মহল অভিযোগ করছে।

জানা যায়, ২১ বছর বয়সী ওই তরুণী যমুনা ফিউচার পার্কের একটি পোশাকের দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করেন। বড় বোনের সঙ্গে উত্তরায় থাকেন খালার বাসায়।

মেয়েটির বড় বোন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ৯টার দিকে কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার জন্য যমুনা ফিউচার পার্কের উল্টো দিকে বাসের অপেক্ষা করছিলেন আমার ছোট বোন। এ সময় হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস এসে ওর সামনে থামে এবং দুই যুবক ওকে জোর করে গাড়িতে তোলে। ভেতরে ছিল আরও তিনজন ছিল। তারা পাঁচজন মিলে চলন্ত গাড়িতে ওকে ধর্ষণ করে রাত পৌনে ১১টার দিকে উত্তরার জসিমউদ্দীন রোডে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়।’

‘মাইক্রোবাসটি ধীর গতি চালিয়ে কুড়িল বিশ্বরোড ও যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের এলাকা দিয়েই কয়েকবার ঘোরানো হয়। তখনও ওরা গাড়ির ভেতরে আমার বোনকে ধর্ষণ করছিল।’- বর্ণনা দেন ধর্ষনের শিকার মেয়েটির বড় বোন।

জানা যায়, গত সপ্তাহের শুরুতে এক লোক দুই বিদেশিকে নিয়ে যমুনা ফিউচার পার্কের ওই দোকানে গিয়েছিল, যেখানে মেযেটি কাজ করতেন।

বড় বোন আরো বলেন, ‘আমার বোন কোথায় থাকে, কত বেতন পায়, পরিবারে কে কে আছে জানতে চেয়েছিল তারা। আমার বোন বলেছে, মাইক্রোবাসে পাঁচজনের মধ্যে সেই লোকও ছিল। দোকানের সিসিটিভির ফুটেজ দেখলে তাকে ও চিনতে পারবে বলে মনে হয়।’

ইতিমধ্যে পুলিশ সেই সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। তা দেখে আসামি সনাক্ত প্রক্রিয়াও চলছে।

রাতে ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করার জন্য তাদের তিন থানায় ঘুরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়ে বলে অভিযোগ করেন তরুণীর বড় বোন।

তুরাগ থানা কাছে হওয়ায় মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তারা সেখানে যান তার পরিবার। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। এরপর ভোর ৫টার দিকে তারা যান গুলশান থানায়। সেখানেও মেলে একই উত্তর। এবার সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গিয়ে অপক্ষো করতে হয় ওসির জন্য। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয় বলে জানান তিনি।

নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, পুলিশের নিস্ক্রিয়তা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ ধরনের অপধারীদের উৎসাহ দিচ্ছে।

এ ঘটনায় মামলা নিতে বিলম্ব কেন ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করা হবে না, অবহেলার জন্য দায়ী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না এবং ধর্ষিতাকে কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে সোমবার রুল দিয়েছে হাই কোর্ট। এছাড়া যৌন হয়রানি ও যৌন সহিংসতা রোধে বিদ্যমান আইন ও প্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করার জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আইনজীবী ও নারী অধিকারকর্মীদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করতে রিটকারীদের কাছে নামের তালিকা চেয়েছে আদালত। আগামী ৩১ মের মধ্যে এই তালিকা আদালতে দিতে বলা হয়েছে রিটকারী সংগঠন নারীপক্ষ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আইন ও শালিস কেন্দ্র ও ব্লাস্টকে।

এদিকে রাজধানীতে গারো তরুণী ধর্ষণ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ ১০ জনকে হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

সংসদীয় কমিটির সভাপতি টিপু মুনশি গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বলেন, ‘আমরা পুলিশকে ইমিডিয়েট অ্যাকশন নিতে বলেছি। যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে পুলিশকে আরও জোরদার ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে।’

ওই মামলার গতি দেখতে তিন সদস্যের ‘তদারক কমিটি’ গঠন করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান।

গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম, গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মাহবুব হাসান, গুলশান জোনের গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার ওবায়দুল হক এই কমিটির সদস্য।
‘তারা মামলার তদন্ত কাজে সহায়তা করবেন এবং অগ্রগতি খতিয়ে দেখবেন’ বলেন ডিএমপির উপকমিশনার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার।

ভাটারা থানার পরিদর্শক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ওই তরুণীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকটি সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং তাতে বেশ সময় লাগছে।’
গুরুত্বের সঙ্গেই কাজটি করা হচ্ছে বলে তিনি বেনারকে জানান।

ধর্ষণের শিকার তরুণী এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে চিকিৎসাধীন আছেন। তবে তিনি মানসিকভাবে বেশ বিপর‌্যস্ত। হাসপাতালের চিকিৎসক বিলকিস বেগম বেনারকে জানান, ‘তার সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়েছে। শারীরিক অবস্থা এখন ভাল। তবে মানসিকভাবে বেশ বিপর‌্যস্ত তিনি। কাউন্সিলরের কাছে আরও কয়েকটি সিটিং লাগবে। এরপর পরিবারের কাছে যেতে চাইলে পাঠানো হবে।’

কর্মজীবী নারী ধর্ষণের এ ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ঢাকার নারী সমাজ।   এ ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিদিনই ঢাকার রাস্তায় চলছে বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন বা প্রতিবাদ মিছিল। নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি উপজাতীয় বিভিন্ন সংগঠনও রুখে দাঁড়িয়েছে। স্বগোত্রের কর্মজীবী নারীদের রাতে বাসায় পৌঁছে দিতে কর্মসূচিও হাতে নিয়েছে গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (গাসু)।

সংগঠনটির সভাপতি ডেনী দ্রং বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ের ধর্ষণের ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে নারীদের সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার পরিচয় মিলেছে। একারণে আমাদের নিরাপত্তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। রোজা-ঈদে যে সকল আদিবাসী, গারো বোন অনেক রাতে কর্মস্থলে থেকে ফিরবেন, তাদেরকে নিরাপদে আবাসস্থলে পৌঁছে দিতে ব্যবস্থা নেবে গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন।”

মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, “ধর্ষণের এই ঘটনাটি অতন্ত মারাত্মক।  এ ঘটনার বিচার না হলে কর্মজীবী নারীরা অনিরাপত্তায় ভূগবেন। পুলিশকে আরও ভূমিকা নিতে হবে এবং অপরাধীদের যত দ্রুত সম্ভব গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”

এর আগে গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ভিড়ের মধ্যে এক দল যুবক নারীদের ওপর চড়াও হয়। ওই ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এক মাসেও কাউকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সিসিটিভির ফুটেজ থেকে আট সন্দেহভাজন নিপীড়কের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের এসব ঘটনার পর নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ‘প্রীতিলতা ব্রিগেড’ গঠন করেছে ছাত্র ইউনিয়ন, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার।

তিনি বেনারকে বলেন, “প্রতিদিন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে তা বেড়ে চলেছে। অপরাধী গ্রেফতারে রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততাই দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। গারো নারী ধর্ষণের তিন দিন পরে মামলা নেওয়া, এবং পহেলা বৈশাখের ঘটনায় পুলিশের যে ভূমিকা তাতে মনে হয় পুলিশ জনগণকে নয়, এখন যৌন সন্ত্রাসীদের নিরাপত্তা দিচ্ছে। প্রতিলতা ব্রিগেড গঠনের মাধ্যমে সারা দেশে ধর্ষণ ও যৌণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।”

এদিকে এভাবে নারীদের নির্যাতিত হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে বলেন, “সরকার যখন নারীর ক্ষমতায়নে সোচ্চার, তখন এভাবে নারীরা রাস্তায় নির্যাতিত হবে, সেটা আমরা আশা করি না। সুষ্ঠু তদন্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মূল আসামিদের শনাক্ত করবে সেই দাবি জানাই। পুলিশেরও এসব বিষয়ে আরও যত্নবান হওয়া উচিত।”

মহিলা ও শিশুবিষয়ক চিকিৎসার পাশাপাশি ওই তরুণীকে আইনগতভাবেও সহযোগিতা দেবে বলে জানান চুমকি। এছাড়া তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করার আশ্বাস দেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।