নিরাপত্তাহীনতায় কর্মজীবী নারীরা, ধর্ষনের ঘটনা বাড়ছে
2015.07.31
নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত দৃষ্টি নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। গত বৃহস্পতিবার রাতেও রাজধানী ঢাকায় কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে এক তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে।
তার পরিবার বলছে, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর উত্তরায় মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়। শুক্রবার ভোরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
গত ২১ মে রাজধানীর কুড়িলে কর্মজীবী এক গারো তরুণীকে জোর করে মাইক্রোবাসে তুলে দেড় ঘণ্টা ধরে চলন্ত গাড়িতে পালা করে ধর্ষণ করা হয়। ওই ঘটনায় দুই গাড়ি চালককে গ্রেফতার করে পুলিশ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব, বিচারহীনতা, আকাশ সংস্কৃতির প্রাদুর্ভাব আর পুরুষের বিকৃত রুচির কারণে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রই তুলে ধরে।
ঘটনার বিবরন
বৃহস্পতিবার ধর্ষণের শিকার হওয়া মেয়েটি উত্তরা আজমপুর রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতেন।
তার বোনের স্বামী জানান, রাতে সেখান থেকে উত্তরা ১২ নম্বর সেকশনে বাসায় ফেরার পথে দুই সহযোগীসহ আরিফ নামে তার এক সহকর্মী মেয়েটিকে রাজলক্ষ্মীর পাশে একটি নির্মাণাধীণ ভবনে নিয়ে যায় এবং পালাক্রমে ধর্ষণ করে।
এ ঘটনায় আরিফকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন।
রাত ১১টার পর বিধ্বস্ত অবস্থায় এক রিকশায় বাসায় ফেরেন সেই তরুণী। রিকশাওয়ালা পরিবারের সদস্যদের বলেন, মেয়েটি দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মাথা ও কোমরে ব্যথা পেয়েছে।
তার ভগ্নিপতি বলেন, “ব্যথা পাওয়ার কথা শুনে আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে সে আমাকে ধর্ষণের ঘটনা খুলে বলে তখন বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়।”
ওই তরুণীকে বর্তমানে রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)।
বিচারহীনতার সংকট
গত এপ্রিল মাসে বর্ষবরণের উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলেনে নামে বিভিন্ন সংগঠন। এ পর্যায়ে নিপীড়কদের ধরিয়ে দিতে পুলিশ পুরস্কারের ঘোষণা দিলেও ওই ঘটনায় এখনো কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
নারীদের এই নিরপত্তাহীনতার বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী-পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতার কারণে নারীর সে অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা কর্মজীবী নারীকে ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য করবে। এসব ঘটনার তাৎক্ষণিক বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপণ করতে হবে”।
তাঁর মতে, ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিচারের শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই মামলা তুলে নেওয়া হয়, বা মীমাংসা হয়ে যায়। অথবা মেডিকেল টিম বা পুলিশের গাফিলতিতে সঠিক তথ্য উপাত্তের অভাবে আসামি খালাস পেয়ে যায়। নারীদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবকেও দায়ী করেন এই নারী নেত্রী।
“তাই এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনায় মেডিকেল টিম, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর সঙ্গে আচরণের নীতিমালা তৈরি করতে হবে। পর্ণগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যা দেখে যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে”, যোগ করেন সালমা আলী।
একশ্রেনীর পুরুষের পশুবৃত্তি
তাসলিমা আহমেদ নামে একজন ব্যাংক কর্মী বলেন, “পেশাগত কারণে প্রতিদিন রাস্তায় বের হই। এমন কোন দিন নেই যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় না। আর সম্প্রতি ‘গণধর্ষণ’ যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এসব খবর শুনে রাস্তায় বের হতে ভয় পাই। পরিবারও দুশ্চিন্তায় ভোগে।”
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হেলালউদ্দিন আহমদ বেনারকে বলেন, মানুষের অবচেতন মনে বিভিন্ন ধরনের প্রবৃত্তি থাকে। সেগুলোর মধ্যে যৌন ক্ষুধা অন্যতম। এই পশুবৃত্তি জেগে উঠলে মানুষ নৈতিকতার জ্ঞান হারায়। সেটা আরো বেশি হয় যখন দেখে এ ধরনের অপরাধ করেও দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি নেই বা আইনের শাসন নেই।
তিনি আরো বলেন, “এ ধরনের অপরাধ কমাতে আইনের শাসন যেমন জরুরি, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নৈতিকতার এবং নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেওয়াও অত্যন্ত প্রয়োজন।”
অনেক সময় সিনেমা বা নাটকের দৃশ্য থেকে যুবকদের মনে এ ধরনের অপরাধের প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তাই নাটক সিনেমা নির্মাতা এবং সম্প্রচারকারকদের আরও দায়িত্ববান হওয়ার পরামর্শ দেন এই মনোবিজ্ঞানী।
দায়িত্ব পালনে তৎপর, দাবি পুলিশের
নারীদের সার্বিক নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকার কোন ঘাটতি নেই বলে দাবি করছে পুলিশ।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার মো. মোনতাসিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, নারীদের যৌন নির্যাতনের প্রায় প্রতিটি ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে আসামিদের আটক করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের ঘটনায়ও পুলিশের তৎপরতায় মূল অভিযুক্তকে আটক করা হয়েছে।
“সুতরাং পুলিশের কোন গাফিলতি আছে বলে মনে করিনা। শুধু নারী নয় সমাজের সকল স্তরের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান আমাদের দায়িত্ব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে”, যোগ করেন তিনি।
নারীকে হতে হবে প্রতিবাদী আর সচেতন
অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, “নারীর নিরাপত্তা দেওয়া যেমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব, নারীদের নিজেদেরও দায়িত্ব আরো সচেতন হয়ে ওঠা। সমাজে নির্যাতনের নানা জাল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হলে প্রতিবাদী হতে হবে, অধিকার সচেতন হতে হবে”।
তাঁর মতে, প্রয়োজেনে নিরাপত্তা কৌশলও শিখতে হবে। কারণ, পুরুষ শাসিত সমাজ বরাবরই চেয়ে এসেছে নারী পিছিয়ে পড়ুক। তাই অগ্রপথিক নারীর উপর আক্রমণ আসবেই। সেখানে দমে গেলে চলবে না। প্রতিবাদী কণ্ঠ আর সচেতন মন নিয়ে সব বাধা দূর করতে হবে।