অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের গণনা করবে বাংলাদেশ
2015.08.13

বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ছবি ও সাধারণ তথ্যসংবলিত একটি ডেটাবেইজ গড়ে তোলা, অনুপ্রবেশের অন্তর্নিহিত কারণ চিহ্নিত করা এবং তাদের আর্থসামাজিক ও জনমিতি-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
সরকার ও দাতাদের ধারণা, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সংখ্যা বেরিয়ে এলে তাদের যেকোনো ধরনের সহায়তা করা সহজ হবে এবং তারা এক ধরনের হিসাব ও জবাবদিহির মধ্যে আসবে।
‘বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক শুমারি, ২০১৫’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গাদের গণনা শুরু হওয়ার কথা। গত এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে।
“যদি সরকার সরাসরি এই শুমারি পরিচালনা করে, তবে আমরা এতে অংশ নিতে চাই। তবে আমরা কোনো বেসরকারি সংস্থা বা তৃতীয় পক্ষের দ্বারা পরিচালিত জরিপে অংশ নিতে চাই না,” টেলিফোনে বেনারকে জানান কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির’ সভাপতি আবু সিদ্দিক।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা নিবন্ধনের আওতায় আসতে চায়। রোহিঙ্গা শুমারির খবরে তারা খুশি।
এ প্রকল্পের জন্য গত মে মাসে ২১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পাস করেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ইতিমধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে প্রকল্প পরিচালককেও।
অনেকে জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে, ক্ষতি করছে পরিবেশের
উদ্যোক্তারা জানান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও পটুয়াখালী- এই ছয়টি জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের শুমারির আওতায় আনা হবে।
“প্রথমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন এবং ওই এলাকায় সক্রিয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাহায্যে রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক তালিকা করা হবে। ওই তালিকাকে ভিত্তি ধরে মাঠপর্যায়ে গিয়ে সংখ্যা গণনা করা হবে,” জানান প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন।
প্রকল্পের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের কুতুপালং ও নোয়াপাড়ায় জাতিসংঘ পরিচালিত শরণার্থীশিবিরে ৩০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বাইরে সঠিক কোনো হিসাব না থাকলেও আনুমানিক তিন থেকে পাঁচ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, সীমান্তে কড়াকড়ি সত্ত্বেও প্রতিদিন গড়ে আট থেকে দশজন মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। এসব রোহিঙ্গা দেশের বনভূমি ধ্বংস করে বাসস্থান গড়ে তুলে পরিবেশের ক্ষতি করছে।
বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে প্রস্তাবে বলা হয়, এ ছাড়া স্থানীয় শ্রমবাজার ও উপকূলীয় সমুদ্র বেষ্টনী প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তারা।
অবহিত করা হচ্ছে কূটনীতিক ও দাতাদের
গত ১০ আগস্ট রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী কয়েকটি রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রতিনিধিদের রোহিঙ্গা শুমারির বিষয়ে জানাতে একটি ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা এবং অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিকদের বিষয়ে গৃহীত ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি’র অগ্রগতি জানাতে আগ্রহী কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
এর কারণ হিসেবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা এবং অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিকদের দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠন বিভিন্ন মাধ্যমে মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছে। তাই অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিকদের শুমারি প্রস্তুতিসহ সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে তাদের জানানো হয়েছে।
প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, “এ শুমারিতে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গাদের ছবি তুলে রাখা হবে। তারা মিয়ানমারের কোন অঞ্চল থেকে, কেন এ দেশে এসেছেন, বাংলাদেশে তারা কোন পেশায় নিয়োজিত আছেন, পরিবারের সদস্য কত জন ইত্যাদি তথ্য সংবলিত শুমারির প্রশ্নমালা তৈরি করা হয়েছে।”
শুমারির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
কোথায়, কত রোহিঙ্গা
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলায় শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ৩০ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছেন।
তবে ক্যাম্পের বাইরে কক্সবাজারসহ ছয়টি জেলায় কয়েক লাখ মিয়ানমারের নাগরিক বসবাস করছেন বলা হলেও এই সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা সরকার, দাতা বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর নেই।
অভিযোগ রয়েছে, এরা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। কেবল দেশেই নয়, ভুল ঠিকানা ব্যবহার করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে কেউ কেউ বিদেশে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।
আবু সিদ্দিক বলেন, এগুলো অবশ্য বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে এগুলো হওয়া উচিত নয়।
কক্সবাজারের স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, উখিয়া উপজেলার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা ১২ হাজার হলেও সেখানে এখন ৭০ থেকে ৯০ হাজার লোক বাস করছেন।
একই অবস্থা টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরেও। এখানকার তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা ১৮ হাজার। কিন্তু এই শিবিরের পার্শ্ববর্তী লেদা এলাকায় রয়েছে আরও অন্তত ২২ হাজার রোহিঙ্গা।
কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের দুই পাশে কলাতলী, বড়ছড়া, হিমছড়ি, দরিয়ানগরসহ আশপাশের এলাকায় পাহাড়ে কাঁচা ঘর তুলে বসতি গড়েছে রোহিঙ্গারা।
এ ছাড়া কক্সবাজার শহরের পাহাড়তলী, লারপাড়া, আদর্শ গ্রাম, টিঅ্যান্ডটি পাহাড়, সার্কিট হাউস, সিটি কলেজ ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকাতেও ছোট-বড় ১২টি পাহাড়ে ১৫ হাজারের বেশি ঘরে বসতি প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার।
“নিবন্ধিতদের বাইরে প্রচুর অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে কক্সবাজারেই। মূলত পাহাড় এবং জঙ্গলে তাদের বসবাস,” জানান রোহিঙ্গা শরণার্থী ও প্রত্যাবাসনের জন্য দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত রিফিউজি রিলিফ অ্যান্ড রিপাট্রেশিয়ান কমিশনার (আরআরসি) এর পরিচালক ফরিদ আহমেদ ভূইয়া।
পরিচালকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মাছ ধরার নৌকাগুলোতে কাজ করে অনেক রোহিঙ্গা। হোটেল-রেস্তোরাঁ, নির্মাণকাজ, ধান কাটাসহ বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে তাঁরা।
“অনিবন্ধিতরা নিজেদের নিবন্ধন চান। সে জন্য তাঁদের সঠিক তথ্য থাকা জরুরি,” জানান ফরিদ আহমেদ।
মিয়ানমারে জাতিগত ও রাজনৈতিক কারণে নিপীড়নের শিকার মুসলিম রোহিঙ্গারা দুই দশক আগে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে।
বাংলাদেশ সরকার এসব শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। নানা দেনদরবারেও সাড়া দিচ্ছে না দেশটি।
এমনকি তারা রোহিঙ্গাদের নিজের দেশের নাগরিক হিসেবেও মানতে নারাজ। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ থাকলেও তাতে পাত্তা দিচ্ছে না মিয়ানমারের সামরিক সরকার।
দেশটিতে ২০১২ সালে নতুন করে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়। সীমান্তে আবারও বাড়তে থাকে রোহিঙ্গাদের চাপ। তবে নতুন কোন রোহিঙ্গাকে ঢুকতে না দেওয়ার অবস্থান নেয় বাংলাদেশ সরকার।