দাম্ভিক রাজনীতিক সাকা চৌধুরীর ফাঁসি বহাল, তেমন প্রতিক্রিয়া নেই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.29
BD-saka সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় বহাল রাখায় শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে সমবেতরা আনন্দ-উচ্ছাস প্রকাশ করে। ২৯ জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

বাংলাদেশের অন্যতম বিতর্কিত রাজনীতিবিদ, স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের মন্ত্রী এবং বিরোধী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

তবে, সাকার পক্ষ থেকে রিভিউর আবেদন করা হবে বলে তার আইনজীবী জানিয়েছেন। এরপর রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদনের সুযোগ নেবেন কি নেবেন না বিষয়টি চূড়ান্ত হবার আগ পর্যন্ত তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এই ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা  নিয়ে প্রকাশ্য কারো অসন্তোষ দেখা যায়নি, বরং ঢাকা ও চট্টগমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির দণ্ড বহাল থাকায় আগের মতোই ‘বিস্মিত’ হয়েছে তার দল বিএনপি;  তবে কোনো কর্মসূচি তারা দেয়নি।

বুধবার বিকালে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন বলেন,  “এই রায়ে আমরা হতাশ, বিস্মিত এবং বেদনাহত।

“আমরা মনে করি, তিনি ন্যায়বিচার পাননি। অন্যায্যভাবে তাকে মুত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।”

জীবনভর স্বেচ্ছাচারী ব্যবহারের কারণে সমালোচিত ওই রাজনীতিক, যিনি কিনা ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মন্ত্রীর মর্যাদায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এক সময়ের রাজনৈতিক উপদেষ্টাও ছিলেন সাকা, যাঁকে কিনা ওআইসির মহাসচিব পদে নির্বাচিত করতে বিএনপি সরকার জোর চেষ্টা চালিয়েছিল।


রায়ের আগে জল্পনা-কল্পনা

রায়ের আগে কয়েকদিন ধরে নানা সন্দেহ ও আশংকার কথা মিডিয়াতে আলোচনা হচ্ছিল। একটি দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে এক বিচারপতির সঙ্গে সাকার পরিবারের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করা হয়। এই খবরের সূত্র ধরে বিভিন্ন মহলের আশংকা ছিল, সাকা চৌধুরীর ফাঁসি মওকুফ হয়ে যাবে এবং এ নিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ ক্ষোভ প্রকাশ করে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও বিচারাধীন এ বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সঙ্গে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার বিষয়টি রাজনীতিতে বিশেষভাবে আলোচিত। সেই সূত্রে বলা হচ্ছিল, সাকা চৌধুরীর ফাঁসি শেষ পযন্ত হবে না।

কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২৯ জুলাই আগে নির্ধারিত তারিখে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।


চার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড

বুধবার সকাল নয়টা পাঁচ মিনিটে আপিলের সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হলো। একটি অভিযোগ থেকে আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হলো। বাকি সাতটি অভিযোগে সাজা বহাল রাখা হলো।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল-১। ওই রায়ের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর আপিল করেন সাকা চৌধুরী।

চলতি বছরের ১৬ জুন আপিলের শুনানি শুরু হয়, শেষ হয় ৭ জুলাই। ওই দিন আদালত রায় ঘোষণার জন্য ২৯ জুলাই তারিখ ধার্য করেন।
চারটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন সাকা চৌধুরী। এগুলো হচ্ছে; নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যা, সুলতানপুর বণিকপাড়া ও ঊনসত্তরপাড়ায় গণহত্যা, হাটহাজারীর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মোজাফফর ও তাঁর ছেলেকে অপহরণের পর খুন করা।



বিচারপ্রার্থী, অপরাধীর স্বজন ও  আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড আপিলেও বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নূতন চন্দ্র সিংহের পূত্র প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহ।
‘‘রায় বহাল থাকায় আমরা খুশি হয়েছি। এখন দ্রুত এই রায় কার্যকর দেখতে চাই,”  টেলিফোনে বেনারকে জানান প্রফুল্ল (৭০)।

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাউজানের গহিরা এলাকায় কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়।

সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে প্রার্থনারত অবস্থা থেকে নূতন চন্দ্রকে টেনে বাইরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে  প্রফুল্ল  বলেছিলেন,  “তারা আমার বাবাকে যখন মন্দির থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে, তিনি তখন ব্যথায় কাতরাচ্ছিলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাকে তিনটি গুলি করেন।”

এদিকে আপিল বিভাগের এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

“সাকা চৌধুরীকে যেসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল যে দণ্ড দিয়েছেন, এর মধ্যে একটি বাদে বাকি সব সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ,”  সাংবাদিকদের জানান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, “সাকা চৌধুরী যে যুদ্ধাপরাধে জড়িত ছিলেন, তা প্রমাণ হলো। এই সাজা যদি না হতো, তাহলে প্রচণ্ড হতাশ হতাম।”

অবশ্য আইনজীবী ও সাকা চৌধুরীর পরিবার রায়ে খুশি নন। আপিল বিভাগের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “রায়ে আমরা হতাশ হয়েছি। আমার বাবা যে নির্দোষ ছিলেন, সেটা একদিন না একদিন প্রমাণিত হবেই।”

“এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তার পরিবারও হতাশ হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা রিভিউ করব,” রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বেনারকে জানান আসামিপক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

খন্দকার মাহবুব হোসেনের ভাষ্য, “সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যদি একাত্তরে এত বড় অপরাধ করতেন, তাহলে বারবার সাংসদ নির্বাচিত হতেন না তিনি।


এটা পঞ্চম আপিলের রায়

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের পঞ্চম আপিল মামলার রায় আজ ঘোষণা হলো। এর আগে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং দুই এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লার আপিলের রায় ঘোষণা করেন আদালত।

এর মধ্যে কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ ভোগ করছেন সাঈদী। আর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি।


কাঠগড়ায়ও দাম্ভিকতা

হরতালে গাড়ি পোড়ানোর এক মামলায় ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তাঁর বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল।

বিচারকাজ শুরু হওয়ার পর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একের পর এক কটূক্তি করেন প্রসিকিউটর ও বিচারকদের প্রতি। বিচারকাজের একদম শুরুর দিকেই তিনি বলেছিলেন, “আমি রাজাকার। আমার বাপ রাজাকার। এখন কে কি করতে পারেন করেন।”

ট্রাইবুন্যালে বিচারের রায় পড়ার সময় পুরোটা সময় সাকা চৌধুরী হেসেছেন এবং কটূক্তি করেন। ৩ নম্বর অভিযোগ পড়ার সময় তিনি বলেন, ‘৩০ লাখ তো মারা গেছে। বলে দিলেই হয়, আমি ২০ লাখ মেরেছি।”

“সালাউদ্দিন কাদের চোধুরীই সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে অহঙ্কারী ব্যক্তি। এই রায়ের মাধ্যমে একজন দাম্ভিক-অহঙ্কারীরও পতন হবে,” জানান ইমরান এইচ সরকার।


আদালত ক্ষুব্ধ ও ব্যাখ্যা দেওয়ার নির্দেশ

গতকাল আলোচিত এই রায় ঘোষণার পাশাপাশি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার প্রকাশক-সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ ও নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে রুল দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আগামী ৩ আগস্ট সকাল নয়টায় তাঁদের আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।

১৬ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় স্বদেশ রায়ের লেখা ‘পরিবারের তৎপরতা॥ পালাবার পথ কমে গেছে’ শিরোনামে একটি কলাম প্রকাশিত হয়। এতে এক বিচারকের সঙ্গে সাকার পরিবারের সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্পাদক ও লেখকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে রুল দেন আপিল বিভাগ।

এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “জনকণ্ঠ পত্রিকার অতি উৎসাহী লেখা বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জনমতে প্রচণ্ড হতাশার সৃষ্টি করে।”

এ ছাড়া গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছেন আদালত।
জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “ইমরানের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে তা দাখিল করতে আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।