বেতন ও মর্যাদার লড়াই, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ
2016.01.08
ব্রিটিশ বা পাকিস্তান আমল, এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন শতভাগ বাড়েনি কখনোই। এ বছর সরকার বেতন দ্বিগুণ করে দিয়ে আরও কিছু সুযোগ–সুবিধা বাড়ালেও সেই অর্থে কেউই সন্তুষ্ট নন।
এ নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন বিরক্ত, তেমনি ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আর অসন্তুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যাংকার, সরকারি কলেজ শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার কর্মকর্তারা আন্দোলন শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ১৫ জানুয়ারি থেকে গণছুটিতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসকসহ ২৬টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা আন্দোলনে আছেন। গত কয়েক মাস ধরে কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় আগামী ২২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা নতুন করে কঠোর কর্মসূচি দেবেন।
বেতন বেড়েছে, বৈষম্যও বেড়েছে
আন্দোলনকারী বিভিন্ন সংগঠনের বক্তব্য হচ্ছে, বেতন বাড়লেও তাঁদের বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য হয়েছে মূলত প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে। যেকারণে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে শিক্ষকসহ অন্য পেশাজীবীদের দ্বন্দ্বও প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, সরকারের প্রশাসন ক্যাডারে আছেন ৫ হাজার ৪৫১ জন কর্মকর্তা।
সরকারি চাকরিতে ২০টি গ্রেড রয়েছে। প্রশাসন ও বিভিন্ন ক্যাডারে পদোন্নতির জট যেমন আছে, তেমনি আছে পদের অভাবও। এত দিন অনেকে পদোন্নতি না পেলেও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল থাকার কারণে উচ্চতর গ্রেডে যেতেন এবং আর্থিক সুবিধা পেতেন। এ কারণে পদোন্নতি না পেলেও তাদের আফসোস খুব একটা থাকত না।এবার টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দিয়েছে সরকার। এতে তাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
এ ছাড়া চাকরির শুরুর পদে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের চেয়ে ক্যাডার কর্মকর্তাদের বেতন স্কেল এক ধাপ ওপরে রাখায় প্রশাসন ক্যাডার বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
“টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়া উচিত নয়। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার বৈষম্য করাটাও ঠিক হয়নি,” বেনারকে জানান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।
প্রশাসন বাদে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারী; বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও অসন্তুষ্ট। প্রজাতন্ত্রের ১২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ব্যাংক, বিমা, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে দেশে প্রায় ২১ লাখ জনবল আছে। এদের অধিকাংশই ক্ষুব্ধ বা অসন্তুষ্ট।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলন চলছে
সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ায় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেড-১-এ যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বেতন স্কেলের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কার্যত তৃতীয় গ্রেড থেকেই তাঁদের অবসরে যেতে হবে।
অবশ্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও গ্রেড-১ ও গ্রেড-২-এ যাওয়ার সুযোগ পাবেন, তবে সেই সংখ্যা আগের তুলনায় কমবে।
আন্দোলনে থাকা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংখ্যা ১২ হাজার ৪৭ জন। গত প্রায় চার মাস তাঁরা আন্দোলন করে আসছেন।
“বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আগের অবস্থানে রাখাটাই যৌক্তিক। এমনকি জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য করা বিশেষ গ্রেডে অধ্যাপকদের কয়েকজনকে রাখা উচিত। ওই গ্রেডে এখন কয়েকজন সচিব ছাড়াও পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর কিছু কর্মকর্তা আছেন,” বেনারকে জানান আলী ইমাম মজুমদার।
সরকারি কলেজ শিক্ষকেরা বঞ্চিত
সরকারি কলেজশিক্ষক (শিক্ষা ক্যাডার) প্রায় ১২ হাজার। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা (বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা) চতুর্থ গ্রেড থেকেই অবসরে যাবেন। এত দিন ৫০ শতাংশ অধ্যাপক সিলেকশন গ্রেড পেয়ে গ্রেড-৩-এ যেতে পারতেন।
নিয়োগবিধি ও পদোন্নতি বিধিমালা সংশোধন করে তাঁদেরও আগের মতো গ্রেড-৩-এ যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
কিন্তু কলেজশিক্ষকেরা বলছেন, প্রজ্ঞাপন জারি করে এখনই বলে দিতে হবে, গত ১ জুলাই থেকেই তাঁরাও গ্রেড-৩-এ যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসকসহ (প্রকৃচি) ২৬ ক্যাডারে কর্মকর্তা আছেন প্রায় ১ লাখ। তাঁরাও আন্দোলন করছেন।
একজন মাধ্যমিক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা
এদিকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানালেন, ১৯৯২ সালে তিনি চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় মূল বেতন ছিল ২৩শ টাকা। এরপর তিনি সপ্তম গ্রেডে উন্নীত হন এবং ওই গ্রেডে এখন মূল বেতন ১৫ হাজার টাকা।
অষ্টম স্কেলের সপ্তম গ্রেডে ওই শিক্ষকের মূল বেতন হবে ২৯ হাজার টাকা। টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেয়ে তিনি এখনই ২১ হাজার ৩০০ টাকা মূল বেতন পান। এই দুটি সুবিধা না থাকলে গত ২২ বছরে তার মূল বেতন হতো ৭ হাজার টাকার কাছাকাছি।
ওই শিক্ষক হিসাব করে দেখালেন, অষ্টম জাতীয় বেতনস্কেলে তাঁর মূল বেতন বেড়েছে ৭ হাজার ৭০০ টাকা, যা বাড়ি ভাড়াসহ ১০ হাজার টাকার কাছাকাছি হবে।
বেতন কমিশন, সচিব কমিটি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুক্তি
বেতন কমিশন ও সচিব কমিটির মত হচ্ছে, সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল যেভাবে বৈষম্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছিল, তাতে এ দুটি ব্যবস্থা চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর আগে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম বেতন কমিশনও এই দুটি বিশেষ ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা ও বৈষম্যের বিষয়গুলো তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ সচিব জানান, “বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার আগেই এখন পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে নতুন জাতীয় বেতন স্কেল হচ্ছে। ফলে বিশেষ সুবিধার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। এখন বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (ইনক্রিমেন্ট) নির্দিষ্ট করে দেওয়ায় একসঙ্গে সবার যাত্রা শুরু হবে।”
“অর্থ বিভাগ হিসাব করে দেখেছে, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে পরিমাণ আর্থিক সুবিধা পেতেন, তা তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট হারে প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট চালু করায় তার চেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন,” সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানান সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইয়া।
অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০তম গ্রেডের চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ হারে প্রথম বছরে বেতন বাড়বে ৪২০ টাকা এবং পরের বছর ক্রম পুঞ্জিত হারে বাড়বে ৪৪০ টাকা এবং এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। প্রত্যেক গ্রেডের জন্য এই সুবিধা আছে। এমনকি যাঁরা ব্লক পদে চাকরিরত তাঁরা স্বীয় স্কেলে এই ক্রম পুঞ্জিত আর্থিক সুবিধা পাবেন, যা জটিল টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থেকে সহজলভ্য হবে।
টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডও যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে, এটা উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একই স্কেলে বেতন পেলেও ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির চাকরিজীবীর জন্য একই ধরনের সিলেকশন গ্রেড বা টাইম স্কেলের বিধান বর্তমানে নেই। ক্যাডার, নন-ক্যাডার ও ব্লক পদধারীদের মধ্যেও অনেক পার্থক্য রয়েছে।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে যাঁরা সচিবালয়ে কর্মরত, তাঁরা আট, ১২ ও ১৫ বছরে টাইম স্কেলের পাশাপাশি ১০ বছরে সিলেকশন গ্রেড পেয়ে থাকেন। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তা না পাওয়ার কারণে একই শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করে।
সচিব কমিটি ও বেতন কমিশনের পর্যালোচনা হচ্ছে, টাইম স্কেল বা সিলেকশন গ্রেড দিতে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা হয়। সাধারণত ডিপিসির সভা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয় না। এসব কারণে এ ধরনের সিলেকশন গ্রেড বা টাইম স্কেল নিয়ে অসন্তোষ থেকে যায়।
অসন্তোষ কমানোর উদ্যোগ
এদিকে সরকার প্রশাসনে অসন্তোষ কমিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চারজন সচিব গত বৃহস্পতিবার নিজেরা বৈঠকে বসেন। এরপর তাঁরা আন্দোলনরত প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির নেতাদের সঙ্গে গতকাল রাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গেও আলোচনা হতে পারে তাঁদের।
আন্দোলনরত শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদসহ অন্যান্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা মনে করছেন, এখন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিষয়টির সমাধান হবে বলে তাঁরা আশাবাদী হয়ে উঠছেন।
তবে টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বন্ধের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানিয়েছে সরকার। তবে গত বৃহস্পতিবার আন্দোলনরতদের সঙ্গে বৈঠকে সরকারের চারজন সচিব জানান, ওই দুটি সুবিধা চালু না হলেও পদোন্নতির জট কীভাবে ছাড়ানো যায়, সে জন্য সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করবে।
“আশা করা যায়, শিগগিরই তাঁদের সমস্যাগুলো সমাধান হবে, এ নিয়ে আলাপ–আলোচনা চলছে,” সাংবাদিকদের জানান জনপ্রশাসনসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।