চাকরিজীবীদের বেতন দ্বিগুণ, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা
2015.09.08
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের গ্রেড ভেদে মূল বেতন ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বেড়েছে। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন বেতন স্কেলের অনুমোদন দেয়া হয়। গত ১ জুলাই থেকে এই বেতন কার্যকর ধরা হবে। এতে ২১ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে স্বস্তির পাশাপাশি অর্থনীতিতে কিছুটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চলতি অর্থ বছরে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা বেতন বাবদ বাড়তি যে চাপ সৃষ্টি করবে তাতে অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করছেন, প্রায় দ্বিগুণ বেতন বৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে।
সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়লেও ঘুষ–দুর্নীতি কমবে কিনা, এমন আলোচনাও শুরু হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে।
খোদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, “প্রায়ই বলা হয়, সরকারি চাকুরেদের বেতন কম, এ জন্য তারা একটু ঘুষ টুস খায়, যাতে এই জিনিসটা আর না হয়...। আশা করছি এখন সরকারি চাকুরেরা বেতন কম এই অভিযোগ আর করতে পারবে না।”
তবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দ্বিগুণ হওয়ায় সেবার পরিমাণ চারগুণ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ‘ঘুষ-দুর্নীতি’ বন্ধ করতে বলেছেন।
“বেতন যেমন দ্বিগুণ হয়েছে, আপনাদের সেবা যেন চার গুণ হয়, আমরা তাই আশা করি। তবে ঘুষের পরিমাণ যেন চারগুণ না হয়,” বেনারকে জানান সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২০ টি গ্রেডে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল অনুমোদন করা হয়। এর বাইরে দুটি বিশেষ গ্রেডে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব পাবেন ৮৬ হাজার টাকা এবং সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিবেরা পাবেন ৮২ হাজার টাকা। নতুন স্কেলে প্রথম গ্রেডে সর্বোচ্চ মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা (নির্ধারিত) এবং ২০তম গ্রেডে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারন করা হয়েছে।
এখন সরকারি চাকুরেরা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল বেতন পান। সর্বশেষ এই বেতন স্কেল দেওয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে।
মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গ
বেতন প্রায় দ্বিগুণ হওয়ায় মূল্যস্ফীতি ঘটবে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ বলছেন, সরকার ঘোষিত এই নতুন বেতনকাঠামোর উল্লম্ফনের ফলে একদিকে যেমন সরকারের ব্যয় বেড়ে বাজারে সঞ্চারিত হবে নতুন অর্থ, তেমনি বেতন বৃদ্ধির খবরে বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে নানান মহলে শুরু হবে মূল্যবৃদ্ধির তোড়জোড় ।
“সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির মাধ্যমে চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধির কোনো অর্থনৈতিক বা মুদ্রা নৈতিক ফলাফল নেই-সে কথাও খুব জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বর্তমান বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের বিপুল টাকা বাজারে যুক্ত হবে,” বেনারকে জানান ব্যাংকার ফারুক মঈনউদ্দীন।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবও কার্যকর হতে যাচ্ছে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে। এ কারণে ভারতীয় অর্থনীতিবিদেরা আগাম পূর্বাভাস করছেন এক ধাপ মুদ্রাস্ফীতির।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বেতন বৃদ্ধির ফলে কোনো মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কা করছে না। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে (জানুয়ারি-জুন ২০১৫) আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে যে, প্রস্তাবিত নতুন বেতন কাঠামোর কারণে কোনো মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে না।
“নতুন জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর হলে মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা নেই,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, যিনি বেতন কমিশনের প্রধান ছিলেন।
তবে সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেতন নির্ধারণের পক্ষে মত দিচ্ছেন। তাঁরা বলেন, বেতন দ্বিগুণ বাড়ার কথা বলা হলেও তা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
“প্রায় ছয় বছর পর আমাদের জাতীয় বেতন স্কেল দেওয়া হচ্ছে। এখন মূল বেতনের ওপর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, যা গ্রেড ভেদে পৌনে চার থেকে পাঁচ শতাংশ হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে মূল্যস্ফীতি এখন সাত শতাংশের কাছাকাছি, বেনারকে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একজন যুগ্ম সচিব।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল এমন একটি পে-স্কেল দেব, যেটা বাজারের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য হবে।”
সশস্ত্র বাহিনীর নতুন বেতন কাঠামো
সশস্ত্র বাহিনীর জন্যও নতুন বেতন কাঠামো অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনী প্রধানের বেতন ও পদমর্যাদা একই রকম করার অনুশাসন দিয়েছেন।
এর আগে সেনাপ্রধানের পদমর্যাদা ও বেতন অন্য দুই বাহিনীর প্রধানের ওপরে ছিল। সেনাপ্রধান এখন ৪৫ হাজার টাকা মূল বেতন পান, অন্য দুই বাহিনীর প্রধান পান ৪২ হাজার টাকা। এখন তিন বাহিনীর প্রধানের বেতন ৮৬ হাজার টাকা করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী প্রধানের র্যাঙ্কও উন্নীত করা হবে।
বেতন বাড়বে ২১ লাখ চাকরিজীবীর
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্য ছাড়াও স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার-এমপিওভুক্ত শিক্ষক, সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে ১ জুলাই থেকে অন্তর্ভুক্ত হবেন।
এ ছাড়া স্ব-শাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের ক্ষেত্রেও এই সময় থেকে নতুন বেতন স্কেল প্রযোজ্য হবে। সব মিলিয়ে বেতন বাড়বে ২১ লাখ চাকরিজীবীর।
তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন, মর্যাদা ও পৃথক বেতন স্কেলের বিষয়টি পর্যালোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেতন বৈষম্য নিরসন-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিকে। এর আগ পর্যন্ত তাঁরা যে গ্রেডে আছেন সেই গ্রেডে নতুন স্কেল অনুযায়ী বেতন পাবেন। আর এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত দেবে, এরপর অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে।
পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে লাগবে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে (২০১৪-১৫) বেতন-ভাতা খাতে সরকারের খরচ হয়েছে ৪৪ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা (৫ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার), যা মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। বেতন বৃদ্ধির ফলে চলতি অর্থবছরে (২০১৫-১৬) বেতন-ভাতা খাতে ৬০ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা (৭ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার) লাগবে, যা বাজেটের ২০ দশমিক ১ শতাংশ।
উল্লেখ্য, এ বছরের জাতীয় বাজেট ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরে শুধু বেতন এবং আগামী অর্থবছরের ১ জুলাই বেতনের সঙ্গে অন্যান্য ভাতা যুক্ত হবে। আগামী অর্থবছরে জাতীয় বেতন স্কেল পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে মোট খরচ হবে ৬৯ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা (৮ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার)।
গ্রেড থাকবে, শ্রেণি বাদ
নতুন বেতন স্কেলে এখনকার মতোই ২০টি গ্রেড। তবে শ্রেণি (প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি) তুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ নিজ গ্রেড দিয়েই পরিচিত হবেন। নতুন বেতন স্কেলে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ রয়েছে।
“ওই দুটি সুবিধা বাদ দেওয়া হলেও পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যেসব নতুন সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে তাতে তাঁরা বরং লাভবান হবেন। টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড কেউ পেতেন, কেউ বঞ্চিত হতেন। এখন বার্ষিক প্রবৃদ্ধি সর্বজনীন করায় সবাই তা পাবেন,” বেনারকে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা।
নববর্ষ ভাতা চালু
সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী, শিক্ষক, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের জন্য বাংলা নববর্ষ ভাতা চালুর বিষয়টি অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।
দেশে ধর্মভিত্তিক উৎসব রয়েছে। কিন্তু বাংলা নববর্ষ ভাতা সব সম্প্রদায়ের মানুষ একই সঙ্গে এবং একই সময়ে পাবেন। এই ভাতা হবে মূল বেতনের ২০ শতাংশ। মন্ত্রিসভা প্রশিক্ষণ ভাতা, ঝুঁকিভাতা, চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতাসহ সব ধরনের বিশেষ ভাতা টাকার অঙ্কে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। প্রেষণ ভাতা তুলে দেওয়া হয়েছে। তবে বাড়িভাড়া এখনকার মতো মূল বেতনের শতাংশ হারে (কোথাও ৪০, কোথাও ৫০ শতাংশ) দেওয়া হবে।
নতুন বেতন-স্কেলে অবসর সুবিধাও বাড়বে। ২০০৯ সালের বেতন স্কেলে সরকারি চাকুরেদের অবসরের সময় মূল বেতনের ৮০ শতাংশ ধরে পেনশন নির্ধারণ হতো। নতুন স্কেলে মূল বেতনের ৯০ শতাংশ ধরে পেনশন নির্ধারণ করা হবে।
“বেতনভাতা বৃদ্ধির এ বিষয়টি খুবই ইতিবাচক। সরকারি কর্মচারীদের স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার জন্য এটা দরকার ছিল”, বেনারকে জানান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার।
তাঁর মতে, অন্য পেশা বা বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা অনেক কম বেতন পান বলে এক ধরনের অতৃপ্তি ছিল। এটি দূর হবে, পাশাপাশি সম্মানজনক এই বেতন-ভাতা মেধাবীদের সরকারি চাকরির প্রতি আকৃষ্ট করবে।