সবার জন্য শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশ
2015.04.17
সবার জন্য শিক্ষার (ইএফএ) লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশের সাফল্য অর্জনের দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে মনে করছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা—ইউনেস্কো। ফ্রান্সের প্যারিসে ১৪ এপ্রিল ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডের ১৯৬ তম সভায় সংস্থাটি এই মত দেয়।
ইউনেস্কো চলতি মাসেই ‘এডুকেশন ফর অল ২০০০-২০১৫: অ্যাচিভমেন্টস অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এটি তৈরি করা হয়েছে ইউনেস্কোর এডুকেশন ফর অল (ইএফএ) গ্লোবাল মনিটরিং কর্মসূচির আওতায়।
ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিক্ষাচিত্র তুলে ধরে বলা হয়, “নিম্ন আয় সত্ত্বেও অল্প যে কয়েকটি দেশ জাতীয় বাজেটে শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছে, বাংলাদেশ সে সব দেশের একটি। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।”
এতে আরও বলা হয়, “১৯৯৯ সালে যেখানে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার হার ছিল ১৮ শতাংশ, ২০১২ সালে তা ২৬ শতাংশে দাঁড়ায়। গ্রাম-শহর উভয় অঞ্চলেই বেড়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার হার। মানের দিক থেকেও এগিয়েছে এ পর্যায়ের শিক্ষা।”
বাংলাদেশ সরকারের ২০১৩ সালের শিক্ষাবিষয়ক এক জরিপের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ৫০ শতাংশ ও পুরুষের ৫৭ শতাংশ শিক্ষিত। জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন নারী ৩৬ শতাংশ এবং পুরুষ ৪৪ শতাংশ। তারা কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে লিখতে, পড়তে ও গাণিতিক যুক্তি সম্পন্ন কাজ করতে পারে এবং ভবিষ্যতে এ দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে তারা সক্ষম।
ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ডের সভায়ও ১৪ এপ্রিল শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের সাফল্য নিয়ে আলোচনা হয়। এসময় মহাপরিচালক ২০১৫ সালের মধ্যে জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) ও ইএফএ লক্ষ্যসমূহ অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
“লক্ষ্য অর্জনে অনেক দেশ বাংলাদেশের অর্জন থেকে পিছিয়ে আছে। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকারের কারণে ২০১৫ সালের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে সার্বিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে,” ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার বরাত দিয়ে ১৬ এপ্রিল জানিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা–বাসস।
ইউনেস্কো বলেছে, প্রাথমিক শিক্ষায় (প্রাইমারি অ্যাডজাস্টেড নেট এনরোলমেন্ট রেট) প্রায় ৯৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডের চলতি অধিবেশন ও সম্মেলন শুরু হয় ১৩ এপ্রিল, চলবে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত। ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
“শিক্ষায় বাংলাদেশের সাফল্য অর্জনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনার সময় বেশ গর্ব অনুভব করেছি। ইউনেস্কো মনে করছে বাংলাদেশ ইএফএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে,” টেলিফোনে বেনারকে জানান ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, যিনি এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব হলেও এর আগে ছিলেন শিক্ষাসচিব।
প্যারিসে এবার সবার জন্য শিক্ষার নতুন খসড়া হচ্ছে। এ বছরই আগের লক্ষ্য অর্জনের মূল্যায়ন হবে। নতুন লক্ষ্য ও গন্তব্য এখন ২০৩০ সাল।
প্যারিসে সম্মেলনে অংশ নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী ১৭ এপ্রিল বেনারকে বলেন, “ওই সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে যেসব শিশু শিক্ষায় আসেনি তাদের ফিরিয়ে আনার উপায় নিয়ে।”
“ইউনেস্কো হিসাব দিয়েছে, বিশ্বের যেসব শিশু এখনো শিক্ষার বাইরে রয়েছে তাদের এই পথে আনতে ২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার লাগবে, যা বিশ্বের সামরিক ব্যয়ের মাত্র চার দিনের খরচ।কিন্তু এই টাকা জোগাড় করা যায়নি, যা খুবই লজ্জার,” জানান রাশেদা কে চৌধুরী।
প্যারিসে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এবার ভারতের একটি অগ্রগতি নিয়ে বিশেষ আলোচনার কথা জানিয়ে মিসেস রাশেদা বলেন, প্রতিবেশী দেশটিতে ‘ফুড ফর অল’ কর্মসূচি সফল হয়েছে। ভারত ১২ কোটি বা ১২০ মিলিয়ন শিশুকে এই কর্মসূচির আওতায় আনতে পেরেছে।
বাংলাদেশ নিয়ে ওই সম্মেলনে আলোচনার বিষয় সম্পর্কে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “২০১৫ সালে সবার জন্য শিক্ষার একটি পর্বের সমাপ্তি ঘটছে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে নতুন কোনো অর্জন নেই। তবে আগের অর্জনগুলোর ধারাবাহিকতা রয়েছে।”
বিশ্বজুড়ে শিক্ষার কোন দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে?—জানতে চাইলে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের আলোচিত ওই এনজিও ব্যক্তিত্ব বলেন, “শিক্ষায় বিশ্বজুড়ে বৈষম্য বাড়ছে। এ ছাড়া শিক্ষার মান বাড়ছে না। তবে শিক্ষার হার বাড়ছে। ঘুরেফিরে এগুলোই ছিল আলোচনার বিষয়।”
সেনেগালের রাজধানী ডাকারে ২০০০ সালে ১৬৪টি দেশ সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার যে অঙ্গীকার করেছে, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি, বিদ্যমান সমস্যা ও ভবিষ্যতে উন্নয়নের জন্য করণীয় নির্দেশ করা হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা প্রসঙ্গে বলা হয়, ২০০০ সালে বাংলাদেশে স্কুলেই যেত না এমন শিশু ছিল ২০ শতাংশ। ২০১০ সাল নাগাদ এর সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়। উপবৃত্তির কারণে স্কুলগামী মেয়েশিশুর হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। স্কুলে খাবার কর্মসূচিও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
“তারপরও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমরা বিণামূল্যে দেশের সব ছেলেমেয়েকে বই দিচ্ছি। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছি। আমাদের সাধ থাকলেও সাধ্য কম। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে যত টাকা শিক্ষায় বরাদ্দ থাকা উচিত সেটি থাকছে না,” বেনারকে জানান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
অবশ্য রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “যেকোনো উপায়ে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এখন শিক্ষায় জাতীয় আয়ের ২ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দ হয়। মানসম্মত শিক্ষা পেতে চাইলে এটাকে ছয় শতাংশে নিতেই হবে।”