যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে গণশুনানিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ
2015.04.23

যৌনকর্মীদের অধিকার বিষয়ক এক গণশুনানীতে রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে দেশে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত এই গণশুনানি শেষে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। প্রতীকি এ গণশুনানিতে বিচারক মিজানুর রহমান রাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে সিদ্ধান্ত নেন; পুনর্বাসন না করা পর্যন্ত পেশা হিসেবে যৌনকর্মীদের স্বীকৃতি দিতে হবে, পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে হবে ও দায়ি পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এছাড়া যৌনপল্লীগুলোর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আদালত এবং বিচারককে যৌনকর্মীদের প্রতি আরো সংবেদনশীল হওয়া, যৌনকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলায় রাষ্ট্রের আইনগত সহায়তা দেওয়া, যৌনকর্মীদের জন্য সংবিধান স্বীকৃত সব অধিকার প্রয়োগ ও সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করাসহ ১০ দফা সুপারিশ করেন তিনি।
“যৌনকর্মীদের যে কোনো অধিকার লংঘনের বিষয়ে দলিল দস্তাবেজ নিয়ে মানবাধিকার কমিশনকে অভিযোগ করা যাবে, মানবাধিকার কমিশন তাঁদের পক্ষে আইনী লড়াই ও প্রশাসনিক সব ব্যবস্থা নেবে,” জানান মিজানুর রহমান।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের যৌনকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সব বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে যৌনকর্মীদের স্বার্থ রর্ক্ষাথে ‘যৌনকর্মীদের অধিকার রক্ষা কমিটি’ করতে হবে যার নেতৃত্বে থাকবেন যৌনকর্মীরাই।
শুনানিতে টাঙ্গাইল থেকে আসা এক যৌনকর্মী তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, “সম্প্রতি টাঙ্গাইলের যৌনপল্লী উচ্ছেদের পর কেউ আমাদের বাড়ি ভাড়া দেয়নি। এমনও হয়েছে, নিজের টাকায় জমি কিনে সেখানে বাড়ি বানিয়েও যৌনকর্মীরা থাকতে পারেননি।”
খুলনা থেকে আসা দ্বিতীয় স্বাক্ষী বলেন, “মৃত্যুর পর যৌনকর্মীদের গোরস্তানে কবর দিতে দেওয়া হয় না। যৌনকর্মীদের জন্য আলাদা একটি কবরস্তান বানানোর দাবি জানাই আমরা।”
সম্প্রতি নির্যাতনের শিকার ঢাকার এক যৌনকর্মী তৃতীয় স্বাক্ষী হিসেবে বলেন, “এলাকার ছয়–সাতজন মাস্তান একদিন আমাকে প্রচণ্ড মারধর করে। জ্ঞান হারিয়ে আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরে থানায় মামলা করতে গেলে তাঁরা বলে মামলা হয়ে গেছে। পরের দিন গেলে বলে মামলার কাগজ হারিয়ে গেছে। তুমি মীমাংসা করে নাও।”
রাজধানীর সদরঘাট থেকে আসা চতুর্থ স্বাক্ষী বলেন, ‘একদিন খদ্দের দুজনের কথা বলে আমাকে নিয়ে যায়। পরে সেখানে চারজনে মিলে আমার সঙ্গে ...। বাড়তি টাকা চাওয়ায় আমাকে পুলিশে দিয়ে দেয় তারা।”
পঞ্চম স্বাক্ষী বলেন, “আমরা তো সমাজে চিকিৎসের ভূমিকা পালন করি। আমরা না থাকলে ঘরের মা-বোনের ওপর হয়তো নির্যাতন চালানো হত।”
পুলিশের আচরণ সর্ম্পকে তিনি জানান, তিন-চারমাস আগে রাস্তায় এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় আমাকে আটক করে মিরপুর থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। রাতে ওই ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হলেও আমাকে নিমর্ম নির্যাতন করা হয়। এমনকি পাঁচ হাজার টাকা নেওয়ার পরও আমাকে চালান করে দেওয়া হয়”।
তিনি বলেন, “আমরা ধরা পড়ার পর টেলিভিশনে ছবি দেখানো হয়। ক্যামেরাগুলো পিছে পিছে যায়। দোষ করলে আমরা করি। কিন্তু আমাদের পরিবার তো সেটার দায় নিতে পারে না। আমাকে দেখানোর মাধ্যমে আমার পরিবারকে হেয় করা হয়।”
ষষ্ঠ স্বাক্ষী বলেন, “একবার এক গাড়ির তলায় পড়েছিলাম। আমাকে হাসপাতালে না নিয়ে পুলিশ ওই গাড়িটাকে আটক করে নিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ওই গাড়ি থেকে কিছু টাকাপয়সা পাওয়া গেলে আমাকে এর ভাগ দেবে।”
টাঙ্গাইল থেকে আসা সর্বশেষ সাক্ষী বলেন, “২০০ বছরের পুরনো এই যৌনপল্লী উচ্ছেদের সময় অনেক সম্পদ লুট হয়ে গেছে। সাড়ে তিন একর জায়গার মালিক ছিলেন ৩৯ জন। জমি খালি করার জন্য শত শত যৌনকর্মীকে তাঁরা বের করে দিল। বিভিন্ন সময় থানায় মামলা করতে গেলে তা না নিয়ে উল্টো তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা করা হয়।”
জবানবন্দীতে তাঁরা খদ্দের, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ মানুষের অত্যাচার, নির্যাতন এবং সহিংসতার কথা তুলে ধরেছেন।
এসব শুনে মানবাধিকার চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, “আজ বিচারকের আসনে বসে আমি গর্বিত নই, লজ্জিত। সামাজিক নানা কারণে মর্যাদা না পেলেও আদিকাল থেকে যৌনবৃত্তি টিকে আছে। এ পেশাকে স্বীকার না করা হল সত্যকে অস্বীকার করা। তাঁরা তো সবাই বাধ্য হয়েছেন এ পেশা বেছে নিতে। অথচ তাঁদের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে মানবাধিকার লংঘন, সংবিধানের লংঘন।”
পরে তাঁদের মানবাধিকার রক্ষায় করণীয় নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত দেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সমন্বয়ক শিপ্রা গোস্বামী, অধ্যাপক হিলাল উদ্দিন খান ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবির। অনুষ্ঠানে দুই শতাধিক যৌনকর্মী, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক ও শিক্ষার্থী, মানবাধিকারকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক, যৌনকর্মীদের অধিকার আন্দোলনে নাগরিক জোট-সংহতি ও সেক্স ওয়ার্কার্স এলাইজ সাউথ এশিয়া যৌথভাবে এ শুনানি করে। শুনানিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাতজন যৌনকর্মী তাঁদের জীবনযাত্রা ও সমস্যা সর্ম্পকে জবানবন্দী দেন।