শহরে বস্তিবাসীর সংখ্যা বাড়ছে
2015.07.01
বাংলাদেশের সব শহরে গরিব ভাসমান বস্তিবাসীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। ডেকে আনছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয়। গ্রামীন দারিদ্র, নদী ভাঙ্গন, কৃষিতে কাজের অভাব এ সবই তাদের নগরমুখি হবার কারণ। বাধ্য হচ্ছে মানবেতর জীবন যাপন করতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত শুমারির ফলাফল বলছে, দেশে বস্তিতে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা ১৭ বছরে আট লাখ বেড়েছে। তবে নগরবিদরা এই সংখ্যা মানতে নারাজ। তাদের দাবি এই সংখ্যা আরো কয়েকগুন বেশি।
গত সোমবার তৃতীয় ‘বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোক গণনা’ জরিপের খসড়া ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল রাত ১২টা থেকে গত ২ মে পর্যন্ত দেশব্যাপী এই জরিপ চালানো হয়। এর আগে ১৯৯৭ সালে একই ধরনের জরিপ চালানো হয়েছিল।
সোমবার প্রকাশিত শুমারির ফলাফলে দেখা যায়, সারাদেশে ২২ লাখ ৩২ হাজার লোক বস্তিতে বাস করেন। এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ ৪৪ হাজার পুরুষ, ১০ লাখ ৮৬ হাজার নারী এবং ১ হাজার ৮৫২ জন হিজড়া।
এর আগে ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় বস্তি শুমারিতে বস্তিবাসীর সংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৪৫৮ জন। সে হিসাবে ১৭ বছরে দেশে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৮ লাখ ৪০ হাজার ৬৫৬ জন।
তবে নগরবিদরা বলছেন, সরকারের জরিপে বস্তিবাসীর সঠিক সংখ্যা উঠে আসেনি।
নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “দেশে বস্তিবাসী বেড়েছে ঠিক। কিন্তু সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।”
তিনি বলেন, “সরকারি হিসেবে শহরের জনসংখ্যা প্রায় চার কোটিরও বেশি। এর ২০ ভাগ দরিদ্র ধরলে হয় ৮০ লাখ। আর দরিদ্ররাই শহরে বস্তিতে বসবাস করে। এর বাইরেও কিছু বাস করে। তবে সেটা বাদ দিয়ে ধরলেও কমপক্ষে ৫০ লক্ষ মানুষ দেশের বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করে। অথচ বিবিএস’র হিসেবে ২২ লক্ষ লোক বস্তিতে বসবাস করে। আমাদের কাছে এ হিসেবটা খুব কম মনে হয়। জরিপটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
ঢাকার উদারহরণ টেনে তিনি বলেন, “বৃহত্তর ঢাকায় প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের বসবাস। এর ২০ ভাগ দরিদ্র লোক ধরলেও সংখ্যা দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩০-৩৬ লাখে। ঢাকার এই সংখ্যার সঙ্গে সারা দেশের বস্তিবাসীর হিসেব মেলে না।”
এদিকে বর্তমান বস্তিবাসীকে গ্রামে ফেরত নিতে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, “এখন পর্যন্ত যেভাবে নগরকেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা চলছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই বস্তিবাসীকে গ্রামে ফেরত নিতে উদ্দীপনার কোন সুযোগ নেই। অল্প কিছু ঘরে ‘ফেরা প্রকল্প’ করে তাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে তাদেরকে পুঁজি সংগ্রহ এবং বিনিয়োগ কাজে স্বাধীনতা দিতে হবে। আর তাহলেই শহরে মানবেতর জীপনযাপনকারীরা গ্রামে ফেরত যেতে উৎসাহিত হবে।”
বস্তিবাসী বাড়ার কারণ
বস্তিবাসী বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়, নদী ভাঙন, গ্রামীন দারিদ্র,কৃষিতে কাজের অভাব সহ নানা কারণে জীবিকার সন্ধানে সারাদেশ থেকে মানুষ নগরে ছুটে আসে, যাদের বড় একটি অংশ বস্তিতে আশ্রয় নেয়। বস্তিতে গাদাগাদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করতে বাধ্য হয় তারা।
এই জরিপের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ জাফর আহাম্মদ খান বস্তির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, এক রুমে খানার ৫ বা ততোধিক লোক একসঙ্গে বাস করে, সরকারি বা আধা সরকারি জমিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছোট ঘর, টং, ছই, টিনের ঘর, আধাপাকা ভবন বা জরাজীর্ণ দালানে বসবাসকারী মানুষকেই বস্তিবাসী হিসেবে গণনা করা হয়েছে।
নজরুল ইসলাম বলেন, “অবশ্যই বস্তির সংজ্ঞা বা আওতা নিয়ে বিবিএস’র কোন বিভ্রান্তি আছে। না হলে বস্তিবাসীর সংখ্যা এত কম হতে পারেনা।”
বস্তিবাসী বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের মোট জনসংখ্যা বাড়ে ১.৩ শতাংশ হারে। কিন্তু শহরের জনসংখ্যা বাড়ে ৪ শতাংশ হারে, যা স্বাভাবিকের তিনগুন। কারণ, গ্রামের গরীব মানুষ শহরে চলে আসে।
সরকারের বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের ফলে সার্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে এবং মানুষের কিছুটা অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে। এরফলে দেশের মানুষের দারিদ্রের হার কমেছে। কিন্তু সংখ্যা কমেনি।
ইকবাল হাবিব বলেন, সামগ্রিক দারিদ্রের সঙ্গে নগর দরিদ্রতার বিরাট পার্থক্য আছে। গ্রামে কর্মসংস্থান না থাকায় মানুষ নগরে ভিড় করে। ফলে গ্রামীন দরিদ্রতার তুলনায় নগর দরিদ্রতা কয়েকগুন হারে বাড়তে থাকে।
নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে বস্তিবাসী
বিবিএস বলছে, বস্তিতে বসবাস করলেও গ্যাস, বিদ্যুৎসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে ভাসমান ও ছিন্নমূল সাধারণ মানুষ। তবে যেসব বেসরকারি সংস্থা বস্তির মানুষ নিয়ে কাজ করছে বলে বিভিন্ন দেশ থেকে অনুদান নিয়ে আসছে, বেশির ভাগ বস্তির মানুষ সে অনুদানের অর্থ পায় না।
বিবিএসের দাবি, বস্তির ৯০ শতাংশ খানায় আলোর প্রধান উৎস হিসেবে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হচ্ছে। বাকি ১০ শতাংশ খানায় কেরোসিনের আলো কিংবা সৌরবিদ্যুতের আলো প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গ্যাস সংযোগ আছে বস্তির ৩৫ শতাংশ খানায়, ৪৮ শতাংশ খানায় এখনো জ্বালানি হিসেবে কাঠ ও বাঁশ ব্যবহার করা হয়। বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৪৮ শতাংশ টিউবওয়েলের এবং ৪৫ দশমিক ২১ শতাংশ ওয়াসার পানি পান করেন। মোট বস্তিবাসীর ৪২ দশমিক ১৯ ভাগ অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবহার করেন। স্যানিটারি টয়লেট ব্যবহার করেন ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২১ দশমিক ১০ ভাগ টিনের টয়লেট এবং ৮ দশমিক ৬৩ ভাগ ঝুলন্ত ও কাঁচা টয়লেট ব্যবহার করেন।
তবে নগরবিদরা বলছেন, এসব বর্ধিত জনসংখ্যার বেশিরভাগই নগর সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এ বিষয়ে নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, “এই নগরীর পরিকল্পনায় নিম্নবিত্ত বা প্রান্তিক তো দূরের কথা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষরাও বিরাটভাবে অবহেলিত। পয়ঃব্যবস্থাপনা, খাবার পানি, আবাসনসহ নানা ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত এবং তার পরের শ্রেণীগুলোকে প্রায় অপাংক্তেয় করে রেখেছে। সে অবস্থায় এ মানুষগুলোর জন্য এ নগরীর পরিকল্পপনা আছে বা থাকবে তা ভাবাই যায়না।”
কোন এলাকায় কত লোক
শুমারির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট বস্তিবাসীর ৭০ শতাংশই বাস করেন সিটি করপোরেশন এলাকায়। এসব এলাকার বস্তিতে প্রায় ১৬ লাখ লোক বাস করেন। মূলত সিটি করপোরেশন ও পাশের এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া খুলনা, কুমিল্লা, বরিশাল, সিলেট, বরিশাল, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও রংপুর সিটি করপোরেশনে বিপুলসংখ্যক বস্তি গড়ে উঠেছে। ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১০ লাখ ৬২ হাজার ২৮৪ জন লোক বস্তিতে বাস করেন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম, এ বিভাগে আছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৬ জন।
খুলনায় ১ লাখ ৭২ হাজার ২১৯ জন, রাজশাহীতে ১ লাখ ২০ হাজার ৩৬ জন, রংপুরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬২৮ জন, সিলেট বিভাগে ৯১ হাজার ৬৩০ জন এবং বরিশাল বিভাগে ৪৯ হাজার ৪০১ জন লোক বস্তিতে বাস করেন। বস্তিবাসীদের মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৭ ভাগ ভাড়া দিয়ে থাকেন। ২৭ দশমিক ২৫ ভাগ মালিক এবং ৬ দশমিক ৯৯ ভাগ থাকেন ভাড়া ছাড়া।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বস্তিবাসীদের ৫০ দশমিক ৯৬ ভাগ নগরে আসেন চাকরির সন্ধানে। দারিদ্র্যের কারণে আসেন ২৮ দশমিক ৭৬ ভাগ। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে আসার হার ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
প্রকল্প পরিচালক জাফর আহাম্মদ বলেন, সারাদেশের বস্তিবাসীর মধ্যে গড়ে ৩৩ দশমিক ২৬ শতাংশ লোকের অক্ষরজ্ঞান রয়েছে। এর মধ্যে বরিশালে বিভাগে ৪৯ শতাংশ বস্তিবাসীর অক্ষরজ্ঞান রয়েছে। এর পর রয়েছে রংপুরে ৪৩ শতাংশ। খুলনা বিভাগের বস্তিবাসীর মধ্যে অক্ষরজ্ঞান রয়েছে ৩৮ দশমিক ৫৪ শতাংশের। চট্টগ্রাম বিভাগের ৩৪ দশমিক ৮১ শতাংশ, ঢাকা বিভাগের ৩০ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং সিলেট বিভাগের ২৬ দশমিক ১১ শতাংশ বস্তিবাসী অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন।
সারাদেশের বস্তিবাসীর মধ্যে ৮৪ দশমিক শূন্য ৭ ভাগ ভূমিহীন, ১৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ জমির মালিক। ৯২ দশমিক ৬৬ শতাংশ মুসলিম, ৬ দশমিক ৭৩ ভাগ হিন্দু রয়েছে। বস্তিতে বসবাসকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ গৃহবধূ। ১৩ দশমিক ৩৩ ভাগ ছাত্র, গার্মেন্টসকর্মী ১৩ দশমিক ১৮ ভাগ, ব্যবসায়ী ৭ দশমিক ৫৮ ভাগ, রিকশাচালক ৬ দশমিক ৯২ ভাগ, চাকরিজীবী ৬ দশমিক ৭১ ভাগ এবং ৬ দশমিক ৪১ ভাগ গৃহকর্মী।
প্রকল্প পরিচালক জাফর আহাম্মদ বলেন, দেশের ১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ লোক মদ পান করে। গাঁজা সেবন করে শূন্য দশমিক ৩১ ভাগ মানুষ। শূন্য দশমিক শূন্য ২ শতাংশ লোক ফেনসিডিল পান করে। হেরোইন ও ইয়াবাসেবী শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।