গরিবের মেয়ে মাবিয়া–মাহফুজার স্বর্ণ বিজয়ে গর্বিত সবাই

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.02.16
BD-sports মেয়েদের ভারোত্তোলনে ৬৩ কেজি ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক জিতেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত।
অনলাইন

দ্বাদশ সাউথ এশিয়ান গেমসে (এস এ গেমস) দু’টি স্বর্ণ জিতেছে বাংলাদেশের দুই নারী। মেয়েদের ভারোত্তোলনে ৬৩ কেজি ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদক জিতেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। আর মেয়েদের সাঁতারে বাংলাদেশকে স্বর্ণ এনে দেন মাহফুজা খাতুন।

বাংলাদেশ প্রথম স্বর্ণের দেখা পাওয়ায় ভারতের মাটিতে বেজেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদেছেন দুই নারী। তাঁরা দেশে ফেরার পর গর্বে মেতেছে গোটা দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের বাসস্থানের দায়িত্ব নিয়েছেন।

দেশের প্রায় সর্বত্র এখন ওই দুই নারীর বিজয় নিয়ে আলোচনা। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকেও তাঁদের নিয়ে আলোচনা হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে দরিদ্র পরিবারের ওই দুই নারীর উঠে আসায় বিস্ময় প্রকাশ করেন মন্ত্রিসভার সদস্যদের কেউ কেউ।


ভারোত্তলনে মাবিয়ার স্বর্ণ জয়

এবারই প্রথম এস এ গেমসে ইভেন্ট হিসেবে যুক্ত হয় মেয়েদের ভারোত্তলন। শুরুতেই ভারতের ভীনার সঙ্গে সীমান্তর লড়াই বেশ জমে উঠে। শেষ পর্বে ভারতীয় লিফটার রীনা ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে গেলে পথ পরিষ্কার হয়ে যায় বাংলাদেশি লিফটার মাবিয়া আক্তার সীমান্তর।

ভারতের গৌহাটির ভোগেশ্বরী ফুকানানি ইনডোর স্টেডিয়ামে ৭ ফেব্রুয়ারি স্ন্যাচ ও ক্লিন অ্যান্ড জার্ক মিলিয়ে ১৪৯ কেজি ওজন তুলেছেন মাবিয়া। স্ন্যাচে ৬৭ কেজি ও ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ৮২ কেজি ওজন তুলেছেন তিনি। এই ইভেন্টে রুপা জেতা শ্রীলঙ্কার আয়েশা বিনোদানী অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন তার থেকে (১৩৮ কেজি)। ব্রোঞ্জ জিতেছেন নেপালের জুন মায়া চান্ডিয়াল, তিনি তুলেছেন ১২৫ কেজি।

মাবিয়া এর আগে ভারতের পুনেতে সিনিয়র, জুনিয়র ও ইয়ুথ কমনওয়েলথ ভারোত্তলন চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক জিতে ছিলেন। ওই সময় স্বর্ণের পাশাপাশি ২টি রৌপ্যপদকও জিতেন তিনি।

এত বড় অর্জনের পরও কেউ একটা ফুল দিয়ে সংবর্ধিত না করায় মন খারাপ করেছিলেন মাবিয়া। সেই খবর পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ফুলে ফুলে সংবর্ধিত হন তিনি।

স্বর্ণজয়ী মাবিয়ার এই আক্ষেপ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সাধারণ পাঠক সবাইকে নাড়া দেয়। কেউ ফোন করে, কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাবিয়ার প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করেন।

“আমার স্বপ্ন এখন অলিম্পিকে খেলা। অলিম্পিকের মঞ্চেও উড়াতে চাই বাংলাদেশের পতাকা,” বেনারকে জানান মাবিয়া আক্তার।

মাবিয়া তার বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগে। ঘিঞ্জি পরিবেশে টিনশেডের দুই কামরায় তাদের বসবাস। বাবা মুদি দোকানদার। আর্থিক অনটনে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। ভালো ভারোত্তোলক হতে যে আমিষ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন সেটাও জোটেনি সব সময়।


সাঁতারে স্বর্ণ মাহফুজার

সীমান্তর পর একইদিন বিকেলে ভারতে আবারও উড়ে লাল-সবুজের পতাকা। সাঁতারে মেয়েদের হান্ড্রেড মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণ পদক জিতে নেন বাংলাদেশি সাঁতারু মাহফুজা খাতুন। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে কোনো দক্ষিণ এশীয় গেমসে সাঁতারে সোনার পদক জিতে নাম লেখালেন তিনি ইতিহাসে।

হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে পাকিস্তানি লিয়ানা ক্যাথেরিনকে পেছনে ফেলে এবারের এস এ গেমস আসরে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় স্বর্ণ দখলে নেন মাহফুজা।

সোনা জয়ের আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে বেদিতে শিখরে উঠেছেন তিনি। নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়, নিজের কীর্তিতে দেশকে করেছেন গর্বিত।

ছোটবেলায় মাহফুজার অভিমান হয়েছিল মায়ের ওপর। শিশু একাডেমি থেকে পাওয়া তাঁর একটি সোনার পদক বাবার চিকিৎসার জন্য বাধ্য হয়েই বিক্রি করেন মা করিমুন্নেসা। প্রধানমন্ত্রী ওই পদকটি ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

যশোরের অভয়নগরে বেড়ে ওঠা মাহফুজার জীবন শুরু হয় অভাব–অনটনে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাবা আহমেদ গাজিকে অসুখে ধুঁকতে দেখছেন। মা করিমুন্নেসা চালিয়ে নিয়েছেন সংসার। এর মধ্যে মাহফুজার পেয়ে বসা খেলার নেশাটাকেও অনেক সময় চাপই মনে হয়েছে করিমুন্নেসার কাছে। মেয়ে যে সারা দিন সাঁতার নিয়েই মগ্ন।

বাবা ছিলেন কাবাডি খেলোয়াড়। মেয়ের খেলার নেশাটাকে তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন জীবনের সবটুকু দিয়েই। অ্যাথলেটিকস কিংবা সাঁতার—যেকোনো একটি খেলাকে বেছে নেওয়ার ইচ্ছা মাহফুজারও ছিল ছোট থেকেই। বড় হয়ে অ্যাথলেটিকস ট্র্যাকেও দৌড়েছেন। কিন্তু শেষ অবধি বেছে নেন সাঁতারই। সেই সাঁতারেই ইতিহাস।

গ্রামের বাড়িতে একটা আধপাকা বাড়ি তুলেছেন সাঁতারের অর্থ দিয়েই। সাঁতারের জন্যই পেয়েছেন নৌবাহিনীর একটি চুক্তিভিত্তিক চাকরি। কিন্তু তাতে সচ্ছলতা আসেনি।

“আমি যেন নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগটা সাঁতারে দিতে পারি, সেই নিশ্চয়তা চাই,” সাংবাদিকদের জানান মাহফুজা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় ইতিমধ্যে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। এখন ফলের অপেক্ষায় আছেন।

“অসচ্ছলতার মধ্যে এগিয়ে যাওয়া এবং ক্রীড়াবিদ হয়ে দেশকে গৌরবের স্বাদ দেওয়া মাবিয়া–মাহফুজাকে এই দেশ যেন মাথায় তুলে রাখে,” বেনারকে জানান কামরুন্নাহার, যিনি শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা কর্মকর্তা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।