ভূসম্পত্তি না থাকায় চাকরি বঞ্চিত হচ্ছে চা শ্রমিক পরিবারের দুই যুবক
2016.02.08
নানা দুর্ভোগ আর দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশের চা শ্রমিকদের জীবন। দারিদ্রতায় পিষ্ট শ্রমিক পরিবারগুলোর দিন কাটে খেয়ে না খেয়ে। তবে তারই মাঝে থাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখা। তেমনই এক পরিবারের সন্তান রাজু প্রসাদ করি, কৃষক বাবা সীতারাম করি ও মা চা শ্রমিক সাবিত্রী করি’র বড় সন্তান। কিন্তু অভাবের মধ্যে থেকেও তাকে পড়াশুনা করিয়েছেন হতদরিদ্র এই বাবা-মা। একটু আলো দেখার আশায়।
নানা প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পড়া রাজু এনেছিলেনও এক টুকরো আলোর সন্ধান। নিজ মেধা আর দক্ষতায় পেয়েছিলেন একটি চাকরি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ‘সোনার হরিণটি’ যেন হাতে এসেও হাতছাড়া হয়ে গেল।
রাজুর মতই আরেক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান বাসিন্দা কলিন্স রোজারিও।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান রোজারিও মিশনারি স্কুল ও স্বজনদের সাহায্যে কলেজ পার হয়ে এখন স্নাতক শ্রেণীতে পড়ছেন। সম্প্রতি চাকরির এক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে রাজু ও রোজারিও পুলিশের কনস্টেবল পদে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু তাদের হতদরিদ্র বাবা-মায়ের নামে কোনো ভূসম্পত্তি না থাকায় যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও চাকরি পাননি রাজু কিংবা রোজারিও। অথচ তারা বাংলাদেশেরই নাগরিক।
এমন অবস্থায় কিছুটা ভেঙে পড়েছে রাজু, রোজারিও এবং পরিবার। তারা বলছেন, দারিদ্রতার কারণেই আমাদের ভূসম্পত্তি নেই্। আর দারিদ্রতা কোন অপরাধ নয়। তাহলে কেন যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও আমরা চাকরি পাবো না।
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিষয়টিকে ‘মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন’ এবং ‘বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী’ বলে উল্লেখ করেছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গত বুধবার মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে কমিশন।
রাজু বাবা মায়ের সঙ্গে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের বাঘাছড়া চা বাগানে থাকেন। আর কলিন্স থাকেন একই জেলার কুলাউড়া উপজেলার গাজীপুর চা বাগানে।
দুজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের ৬ থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মৌলভীবাজার পুলিশ লাইনস মাঠে কনস্টেবল পদে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয়। এরপর কয়েকটি ধাপের পরীক্ষায় যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন তারা। কিন্তু গত ২৭ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) দেওয়া চিঠিতে তারা জানতে পারেন, ভূসম্পত্তি না থাকায় যাচাই (ভেরিফিকেশন রুলস) বা তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পুলিশের এ সিদ্ধান্ত দুজনকে জানিয়ে দেওয়ার জন্যও নির্দেশ দেন পুলিশ সুপার।
চাকরি নিশ্চিত জেনে যোগ দান প্রস্তুতির পূর্ব মুহুর্তে কর্তৃপক্ষের এ ধরনের সিদ্ধান্তে ভেঙে পড়েছে পরিবার দুটি।
এ বিষয়ে পুলিশের চাকরি প্রার্থী রাজু প্রসাদ করি বেনারকে বলেন, “সর্বশেষ ধাপ মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরে পুলিশ বিভাগ থেকে যারা ভেরিফিকেশনে এসেছিলেন তারা ট্রেনিংয়ের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। এমন খবরে বাড়িতে খুশির হাওয়া বইছিল। জীবনে প্রথম এত খুশি হতে দেখি বাবা-মাকে”।
সে আরো জানায়, কিন্তু বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পরেও আমার ডাক আসে না। অথচ আমার যে কজন বন্ধু আমার সঙ্গে একই পরীক্ষায় টিকেছে, তারা যোগদানপত্র হাতে পেয়েছে। পরে আমি স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করলে তারা একটি চিঠি পড়ে শোনান, যেখানে বলা হয়- ভূসম্পত্তি না থাকায় আমাদেরকে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।
বিষন্ন গলায় রাজু বলেন, ‘আমি এদেশের নাগরিক। চাকরি পাওয়া আমার অধিকার। শুধুমাত্র ভূসম্পত্তি না থাকায় আমি সে অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। দারিদ্রকে জয় করে আমার বাবা মা আমাকে পড়া-লেখা শিখিয়েছে। বাকি এক ভাই ও এক বোন আমার উপর নির্ভরশীল। বাবা মা দুজনেরই বয়স হয়েছে। আবার চাকরি হওয়ার পরেও যোগ দিতে পারছি না খবর পেয়ে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় খুব হতাশ হয়ে পড়েছি।’
অপর চাকরি প্রার্থী রোজারিও বেনারকে বলেন, ‘আমার বাবা বহুদিন ধরেই বিছানায় পড়ে আছেন। মা কাজ করেন। আমি বংশপরম্পরায় এই চা-বাগানে বাস করছি। আমার স্কুল-কলেজে স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে চা-বাগানের ঠিকানাই দেওয়া আছে। স্থায়ী ভিটে কেনার ক্ষমতা আমার পরিবারের নেই। আমার পড়াশুনা চলে মিশন আর আত্মীয়দের সহায়তায়। এমন অবস্থায় চাকরিটা সত্যি আমার কাছে সোনার হরিণ। কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি, আমরা এভাবে বঞ্চিত হব। তাও খোদ নিজ রাষ্ট্রের কাছে।’
উভয়ই তাদের বিষয়টি পূর্নবিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। এ বিষয়ে পুলিশ প্রধান বরাবর চিঠিও দিয়েছেন তারা।
সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে মানবাধিকার কমিশনের চিঠি
জানা যায়, এ ঘটনার বিবরণ জানিয়ে গত বুধবার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ জানায় বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন (বিডিইআরএম)।
বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, সাধারণত দেখা যায়, কেউ যদি কোনো এলাকায় ভোটার হয়ে থাকেন, তবে তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে বিবেচিত হন।
এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, শুধু ভূসম্পত্তি না থাকায় দুজন প্রার্থীকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও বাংলাদেশের সংবিধান পরিপন্থী। কমিশন এই দুজনের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়ারও অনুরোধ জানায়। নইলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়।
জানা যায়, বাংলাদেশের প্রায় সব চা-বাগানের জমি সরকারের কাছে থেকে বিভিন্ন মেয়াদে ইজারা নেওয়া সম্পত্তি। প্রায় দেড় শ বছর আগে এই অঞ্চলে চা চাষের শুরু। সেই সময় থেকেই চা-শ্রমিকেরা এখানে বাস করে আসছেন।
বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক আফসানা বিনতে আমিন বলেন, চা বাগানের কাছে শ্রমিকদের বসবাস করার জন্য ‘লেবার লাইন’ রয়েছে। সেখানে শতবছর ধরেই চা-শ্রমিকরা বসবাস করে আসছেন। এসব শ্রমিকদের সন্তানরা অন্য চাকরিও পাচ্ছেন। তাহলে পুলিশের চাকরি ক্ষেত্রে এই নিয়ম কেন? কেন তারা যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও বঞ্চিত হবেন।
বংশ পরম্পরায় চা শ্রমিকরা শত বছর ধরে এসব জমিতে বসবাস করার পরেও তাদের কোনো মালিকানা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে রাজু ও রোজারিও’র চাকরির প্রসঙ্গে পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়মের দোহাই দেওয়া হচ্ছে। তবে সরকার বলছে, বিষয়টি সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহ জালাল বলেন, ‘পুলিশের সদর দপ্তর থেকে দেওয়া নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা আছে, চাকরির ক্ষেত্রে প্রার্থী, তার মা-বাবা বা বৈধ অভিভাবকের ভূসম্পত্তি থাকতে হবে। আমি নিয়মে আটকা পড়ে গেছি। তবে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে তা সম্ভব বলে জানান তিনি’।
সংশোধনের উদ্যোগ নেবে সরকার
এদিকে বিভিন্ন মহল থেকে পুলিশের এই নির্দেশিকা বদলের দাবি তোলা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু চা শ্রমিক নয়, তাদের মত অনেকেরই নিজস্ব জমিজমা নেই। পুলিশের চাকরি করতে হলে ভূসম্পত্তি থাকার এই নিয়ম অনেক পুরোনো। সময় এসেছে এটি পরিবর্তন করা।
বিষয় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘চাকরির ক্ষেত্রে ভূসম্পত্তি থাকার বিষয়ে পুলিশের একটি নীতিমালা আছে। যা বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা তৈরি করছে। এর সংশোধনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’